বাংলার প্রতিচ্ছবি : প্রশাসনে চাকরি হারানোর আতঙ্ক ভর করেছে। এর ফলে এক ধরনের স্থবিরতা নেমেছে সরকারের শীর্ষ প্রশাসনিক দফতর বাংলাদেশ সচিবালয়ে। এর প্রভাব পড়ছে জেলা প্রশাসন, এমনকি উপজেলা প্রশাসনেও। নতুন আতঙ্ক সম্পর্কে মুখ খুলতে রাজি হচ্ছেন না কোনও কর্মকর্তা। তারা সরকারি কাজেও মন বসাতে পারছেন না। প্রতি মুহূর্তে আতঙ্কে থাকছেন, কখন কোন সিদ্ধান্ত আসে। এসব কারণে ব্যাহত হচ্ছে নাগরিক সেবা। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে নিরপরাধ কর্মকর্তারা কোনও সমস্যায় পড়বেন না। বাংলাদেশ সচিবালয়, কয়েকটি জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, সরকারি চাকরি আইন ২০১৮-এর বিধানমতে ৬২টি ধারা সংবলিত ১৩টি অধ্যায় আছে। এ আইনে সরকারি কর্মচারীদের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়েছে। আইনে সরাসরি জনবল নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধা ও উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার বিধান রাখা হয়েছে। রয়েছে মেধা, দক্ষতা, জ্যেষ্ঠতা, প্রশিক্ষণ ও সন্তোষজনক চাকরি বিবেচনাক্রমে পদোন্নতি দেওয়ার বিধানও।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত সরকার পদায়ন, নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে সরকারের চাকরি আইন ২০১৮ অনুসরণ করেনি। রাজনৈতিক বিবেচনায় দেওয়া হয়েছে পদায়ন, নিয়োগ ও পদোন্নতি। এসব নিয়োগ, পদায়ন ও পদোন্নতি পেতে কোনও কোনও কর্মকর্তা সেই সময়কালের সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তি বা মন্ত্রী অথবা এমপিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়েছেন। নিয়েছেন পদোন্নতি, নিয়োগ ও পদায়ন। আওয়ামী লীগ সরকারের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে এসব কর্মকর্তা পেয়েছেন বাড়তি সুবিধা। এসব কারণেই গত ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত বিতর্কিত নির্বাচনের সময় তারা প্রতিবাদ করেননি। বর্তমান সরকার মনে করে, এর ফলে জাতি যে পর্যায়ে এসেছে, সেখান থেকে মুক্ত হতে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন বিধায় সরকার তেমন সিদ্ধান্তই নিয়েছে। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আপাতত বিভাগীয় ব্যবস্থা হিসেবে ওএসডি এবং বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হচ্ছে। যারা এসব কাজের সঙ্গ যুক্ত নয় তারা কোনও ধরনের ঝামেলায় পড়বেন না বলেও জানানো হয়েছে।
এদিকে এ প্রসঙ্গে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে, প্রশাসনে যেসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতিতে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যাবে, তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে মামলা করা হবে। দুদক ব্যবস্থা নেবে। যাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তাদের কাউকে ওএসডি করা হয়েছে, কাউকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে অর্থ সংক্রান্ত অপরাধের অভিযোগ পাওয়া যাবে তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে তদন্ত সাপেক্ষে সেগুলো অধিকতর তদন্তের স্বার্থে দুদকে পাঠানো হবে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, যারা অপপ্রচার কিংবা কোনও অপরাধের সঙ্গে জড়িত না, এ রকম কিছুই করেননি; সাময়িক ওএসডি হয়েছেন, তারা স্বাভাবিক জীবনযাপন করবেন, এটা কোনও সমস্যা নয়। এখানে সরকার বায়াসড না, সরকার অত্যন্ত সচেতনভাবে কাজটা করবে। যেন একজন নিরীহ কর্মকর্তাও কোনও সাজা বা অসম্মানিত না হন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, শুনেছি ঢাকায় সচিবালয়ে নাকি খুবই ঝামেলা হচ্ছে। সচিবদের অবসরে পাঠানো হচ্ছে। যুগ্ম সচিবদের ওএসডি করা হচ্ছে। এসব সংবাদ শুনে এখানে আমরাও আতঙ্কে আছি। আমাদের ডিসি স্যারকেও দেখেছি মোবাইল ফোনে ঢাকায় তার ব্যাচমেটদের সঙ্গে কথা বলছেন, বিভিন্ন খোঁজ-খবর নিচ্ছেন। এ কারণে ফাইলপত্র দেখার কাজেও মন বসাতে পারছেন না।
সরকারের সিদ্ধান্তে সদ্য বাধ্যতামূলক অবসরে যাওয়া একজন সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, চাকরিতে অবসর নেওয়া একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। সরকারি চাকরি আইনে চাকরিতে ২৫ বছর পূর্ণ হলে নিজের ইচ্ছায় বা সরকারের ইচ্ছায় অবসরে যাওয়া বা অবসরে পাঠানোর বিধানও রয়েছে। কিন্তু সেখানে রাজনৈতিক তকমা লাগিয়ে ওএসডি করা বা অবসরে পাঠানোটা খুবই দুঃখজনক, যা আমাদের ক্ষেত্রে করা হচ্ছে।
তিনি দৃঢতার সঙ্গে বলেন, চাকরি জীবনে আমরা প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মচারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি মাত্র। সরকার যেখানে যে দায়িত্ব দিয়েছে, সেই দায়িত্ব সততার সঙ্গে পালন করেছি। যা চাকরি বিধিতে রয়েছে। আমরা তাই করেছি। যেটি আমার দায়িত্ব এবং কর্তব্য। সেটি যদি অপরাধ হয়, তাহলে বর্তমান সরকারের সিদ্ধান্তে যেসব কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করছেন তারাও ভবিষ্যতেও অপরাধী সাব্যস্ত হবেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বিভাগীয় কমিশনার বলেন, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করাটাই আমাদের চাকরির প্রধান শর্ত। আমরা তা-ই পালন করছি। তবে আমার আশঙ্কা হচ্ছে, বর্তমান সরকারের আমলে আমরা যারা বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করছি, ভবিষ্যতে আমরাও বর্তমান সরকারের দোসর হিসেবে চিহ্নিত হবো এবং অপরাধের ভাগী হবো। যা প্রশাসনে কোনও কল্যাণ বয়ে আনবে না।
জানা গেছে, শেখ হাসিনার শাসনামলে গত তিনটি নির্বাচনে (২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪) দায়িত্বে থাকা জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) মধ্যে যাদের চাকরির বয়স ২৫ বছর পূর্ণ হয়েছে, তাদের বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। আর যাদের চাকরির বয়স ২৫ বছর পূর্ণ হয়নি, তাদের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হচ্ছে। একইসঙ্গে গত সরকারের আমলে মন্ত্রণালয় ও বিভাগে গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা কর্মকর্তা, বিশেষ করে সচিব এবং অতিরিক্ত সচিবদেরও বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হচ্ছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চাকরির বয়স ২৫ বছর পূর্ণ হওয়া ২২ জন সাবেক ডিসিকে (বর্তমানে সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব, উপসচিব) বৃহস্পতিবার বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ার কারণে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব জাকিয়া সুলতানা এবং বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা করার অভিযোগে যুগ্ম সচিব ধনঞ্জয় দাসকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এর আগে বুধবার একই কারণে ৩৩ জন সাবেক ডিসিকে ওএসডি করা হয়েছে। এরও আগে ১২ সাবেক ডিসিকে ওএসডি করা হয়। এমন পরিস্থিতিতে আওয়ামী আমলে প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ পদে যারা (প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ, মন্ত্রীদের পিএস) দায়িত্ব পালন করেছেন তাদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। চাকরি হারানোর পাশাপাশি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলার ঘানি টানার আশঙ্কায় রয়েছেন তারা।
সম্প্রতি ডিসি ফিটলিস্টে নাম তুলতে পরীক্ষা দিয়েছেন এমন একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এই সরকারের ডিসি হলে পরের সরকার কীভাবে নেবে তা বুঝতে পারছেন না। পরে আবার ফেঁসে যাবেন না তো- এই আশঙ্কায় রয়েছেন তারা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মোখলেস উর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘সম্প্রতি জনপ্রশাসন সম্পর্কিত একটি কমিটি হয়েছে। সেখানে চার জন উপদেষ্টা আছেন। এই কমিটিতে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও আমি আছি। এখানে বড় কিছু সিদ্ধান্ত হয়েছে। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচন রিটার্নিং অফিসারদের সহযোগিতায় সম্পন্ন করে সরকার। তারা (ওই সময়ের ডিসিরা) অনেক বড় নেগেটিভ ভূমিকা রেখেছিলেন। কোনও একজন ডিসিও বলেননি আমি রিটার্নিং অফিসার থাকবো না, রিজাইন করলাম, কাজ করবো না। আমরা তাদের মধ্যে ৪৩ জনকে (ডিসি) ওএসডি করেছি, যাদের চাকরির বয়স ২৫ বছরের কম। আর চাকরির বয়স ২৫ বছরের বেশি এমন ২২ জন সাবেক ডিসিকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়ার আদেশ জারি করা হয়েছে। এর মধ্যে সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব ও উপসচিব রয়েছেন। বিতর্কিত নির্বাচন করার সময় প্রতিবাদ না করার ফলে এই জাতি যে পর্যায়ে এসেছে, সেখান থেকে মুক্ত হতে এই (শাস্তিমূলক) ব্যবস্থা নিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা বর্তমান ডিসিদের এই মেসেজ দিতে চাচ্ছি, আগামী নির্বাচনে আপনারা রিটার্নিং অফিসার হবেন, ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে থেকে সাহসের সঙ্গে আইন-কানুন মেনে রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করবেন। যারা করবেন না, তাদের ফল কী হবে এই মেসেজ নিশ্চয়ই পাচ্ছেন তারা।’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে একজন কেবিনেট সচিব বলেন, আমলারা কাজ করেন সরকারের সিদ্ধান্তে। এটিই আমলাদের বৈশিষ্ট্য। সেখানে আমলারা সরকারকে কোনও ঘটনায় প্রভাবিত করেছেন এটি বিশ্বাসযোগ্য নয়। সেই অপরাধে যে ব্যবস্থা বর্তমান সরকার নিচ্ছে এতে প্রশাসনে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। এতে প্রশাসনিক কাজের গতি ব্যাহত হচ্ছে। সবাইকে ধরতে হলে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি ১৩-১৪ লাখ লোককেই ধরতে হবে। এভাবে শুধু ডিসি-এসপিদের ধরলে প্রশাসনে এক ধরনের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়বে। এতে প্রশাসনে স্থবিরতা দেখা দেবে। একসময় কেউই ডিসি-এসপি বা পিএসের দায়িত্ব নিতে চাইবে না।