বাংলার প্রতিচ্ছবি ।। ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪ ।। ১৫:৩৩ : বাংলাদেশের অন্যতম সুনামধন্য রূপালী ব্যাংক পিএলসি. বিগত দীর্ঘ ১৪ বছর যাবৎ আওয়ামীলীগের ফ্যাসিস্টদের হাতে বন্দী। জনরোষে সরকার পলায়ন করলেও ২০১০ থেকে শুরু করে আজও এই বন্দী অবস্থা বিদ্যমান রয়েছে। গত ৫ই আগষ্ট ২০২৪ সালে দেশের ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন হলেও এ ব্যাংকের ফ্যাসিস্টরা বহাল তবিয়তে রয়েছেন বলে অভিযোগ ব্যাংকের বিভিন্ন কর্মকর্তাদের। পালিয়ে যাওয়া আওয়ামী সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত জাহাঙ্গীর-কে এ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদ থেকে ইতোমধ্যে সরানো হয়েছে। বিভিন্ন সুত্র মতে এ ব্যাংকে মূলত সাবেক এমডি ফরিদ উদ্দিন থেকে শুরু হয়ে আতাউর রহমান প্রধানের মাধ্যমে আওয়ামী ফ্যাসিজম ফুলেফেঁপে জাহাঙ্গীরের আমলে অবশেষে ষোলকলা পূর্ণ হয়।
নাম না বলার শর্তে কয়েকজন কর্মকর্তারা বলেন, ২০১০, ২০১১ ও ২০১৪ সালে জাহাঙ্গীর গংরা আবেদন ও পরীক্ষাবিহীন অবৈধভাবে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের সি: অফিসার ও অফিসার হিসাবে অত্র ব্যাংকে পূনর্বাসন করে যারা স্বাধীনতা ব্যাংকার্স পরিষদ নামে পতিত সরকারের আমলে অত্র ব্যাংকের সকল ক্ষেত্রে নৈরাজ্য সৃষ্টি করতো। বর্তমানে এদের অনেকেই আবার জিয়া পরিষদের ব্যানারে (বিশেষ করে মন্জুর চৌধুরী, জোনাল অফিস, ঢাকা উত্তর, জাহিদ, শৃংখোলা ও আপিল বিভাগ, রাকিব, রমনা কর্পোরেট শাখা, সাজ্জাদ হোসেন, শ্যামলী শাখা, রেজ্জাকুল হায়দার, হাতিরপুল শাখা) প্রমোশনসহ অবৈধ সুবিধা নেয়ার পায়তারা করছে। বিগত পতিত সরকারের আস্থাভাজন হওয়ার জন্য শেখ মুজিবরের নামে বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালনে সর্বোচ্চ আর্থিক তসরূপ যা ব্যাংকিং ইতিহাসে নজীরবিহীন, এক্ষেত্রে জাহাংগীরের সকল দুষ্কর্মের সহচর ও হোতা পিআরও নোয়াখালী জামান (এসপিও) । আর সকল কুকর্মের পরামর্শক, নীতি নির্ধারনী ও বাস্তবায়নকারীগণ হলেনঃ ১) ডিএমডি হারুন, ২) লোকাল অফিসের জিএম মাসুদ, ৩) বোর্ড সচিব সায়েদ, ৪) জাহাঙ্গীরের পিএস মঞ্জুর ও ৫) মতিঝিল শাখা প্রধান শাহজাহান।
সুত্র থেকে আরো জানা যায়, বিগত আওয়ামী সরকারের আস্থাভাজন ব্যবসায়ী বিশেষভাবে বেনামী জামানতে আরবিটেক্স লিমিটেড, থারমেক্স, সিস্টার ডেনিম, ওরিয়ন গ্রুপকে ঋণ দেয়াসহ তার আস্থাভাজন ও অপকর্মের সহচরদের বিভিন্ন অনিয়মে জড়িত এমনকি মামলা বিচারাধীন থাকা সত্বেও ব্যাংকিং বিধি লংঘন করে জাহাঙ্গীরকে পদোন্নতি প্রদানসহ অন্যদেরকে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পদায়ন করে। মো: জাহাঙ্গীর এলডিএ হিসেবে ব্যাংকে যোগদান করে ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদ বাগিয়ে নিয়েছেন, যা ব্যাংকিং ইতিহাসে প্রথম।
ফ্যাসিস্ট সরকার ও জাহাঙ্গীরের পতন হলেও এ ব্যাংকে জাহাঙ্গীরের পেতাত্মা এখন রয়েছে এমন অভিযোগ অনেকের। তারা এখনও ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় থেকে এমনভাবে পরিচালিত করছে যে, ব্যাংক ব্যবস্থাপনা তাদের হাতের মুঠোয় রাখছে। এক্ষেত্রে ব্যাংকের নীতিমালা এমনভাবে প্রনয়ন করছে যে তারা ও তাদের দোসররা সবসময় ঐ নীতিমালার আওতায় লাভবান থাকে। জাহাঙ্গীরের মূল অনুসারী হিসাবে পরিচিত জিএম মঞ্জুর হোসেন, মো. জহিরুল ইসলাম, মো: ইউসুফ হারুন খান, আবদুল্লাহ আল অদুদ, মো: মাহমুদ হাসান, মো: সালাহ উদ্দিন,ফাতেমা মমতাজ, মোহাম্মদ শাহেদুর রহমানসহ আরো অনেকে।
পদন্নতি বঞ্চিত কয়েকজন জানান, জাহাঙ্গীর ২০১১ সালে প্রশাসন ও মানবসম্পদ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান থাকাকালীন এ ব্যাংকে সহকারী অফিসার (গ্রেড-১), সহকারী অফিসার (গ্রেড-২), জুনিয়র অফিসার, মার্কেটিং অফিসার, কেয়ারটেকার (পিয়ন) পদে অবৈধ নিয়োগ দিয়েছেন। এসব নিয়োগের ক্ষেত্রে ২০১০ সাল থেকে অগ্রণী ভূমিকায় ছিল আবদুল্লাহ আল অদুদ, মো: মোস্তাফিজুর রহমান, জিএম মঞ্জুর হোসেন, মো: ইউসুফ হারুন খান, মো: মাহমুদুল ইসলাম এবং ২০১৯ সালেও নিয়োগে অগ্রণী ভূমিকায় ছিলেন আবদুল্লাহ আল অদুদ, জামাল আবু নাছের, আবু শাহরিয়ার সোহাগ, রবিউল ইসলাম।
তারা আরো বলেন, এই কর্মকর্তরা প্রশাসন ও মানবসম্পদ বিভাগে কর্মরত থাকা অবস্থায় তাদের আত্মীয়দের এ ব্যাংকে অস্থায়ী পদে নিয়োগ দিয়ে পরবর্তীতে সুকৌশলে স্থায়ী করেছেন। ঐ সময়ে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সহকারী মো: জহিরুল ইসলামের ভাই মো: মাহবুব আলম, ও বোন তফুরা আক্তার নিপাকে নিয়োগ দিয়েছেন। ঐ সময়ে নিয়োগপ্রাপ্তদের অসংখ্য বরিশাল, নোয়াখালী অঞ্চলের লোক ছিল। পরবর্তীতে এমডি আতাউর রহমান প্রধান একই প্রক্রিয়ায় উত্তরবঙ্গের তার আত্মীয় ও অন্যান্য লোকদের নিয়োগ দেয়। উক্ত নিয়োগ প্রক্রিয়ার প্রায় ৭৫% ছিল উত্তরবঙ্গের। আতাউর রহমান প্রধান বিভিন্ন সময়ে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ছিলেন।
উপরোক্ত পদ্ধতিতে এভাবে ব্যাংকের অনেক কর্মকর্তা/কর্মচারীর নিকট আত্মীয়, বোন-ভাই, ছেলে-মেয়ে, স্বামী-স্ত্রীদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এছাড়া এমন অনেককে নিয়োগ দেয়া হয়েছে যাদের বয়স ৩৩-৪২ বছরের মধ্যে যা বাংলাদেশে প্রচলিত আইনের উর্ধ্বে। ফলে এই ব্যবস্থায় জড়িতদের সুষ্ঠু তদন্ত করে চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনা প্রয়োজন বলে মনে করছে অধিকাংশ কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। ব্যাংকে দীর্ঘদিন অস্থায়ী ভিত্তিতে কর্মরত লোকদের স্থায়ীকরণের নিমিত্ত ২০১১ সালে একটি গোপন ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এদের স্থায়ী করা হয়। অথচ যারা প্রকৃতপক্ষে ব্যাংকে দীর্ঘদিন অস্থায়ী ছিল তাদের স্থায়ী করা হয় নাই বলে অভিযোগ তাদের। বর্তমানে লোকাল অফিসে কর্মরতসহ অনেক অস্থায়ী রয়েছেন যারা বৈষম্যের শিকার।
২০১১ সালে কর্মকর্তারা ব্যাংকে অস্থায়ী পদে কর্মরতদের স্থায়ী করার নিমিত্তে তাদের আত্মীয়দের (যারা দীর্ঘদিন ব্যাংকে কর্মরত ছিলনা) সুকৌশলে একটি লিস্ট করে পরিচালনা পর্ষদে উপস্থাপন করে এবং উক্ত নিয়োগের সম্পর্ণূ ক্ষমতা ব্যবস্থাপনা পরিচালকের হাতে নিয়ে অবৈধ নিয়োগ কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকে। এভাবে ২০১১ সাল ২০১৯ সাল পর্যন্ত নিজেদের অনেক লোকদের স্থায়ীকরণে আব্দুল্লাহ আল অদুদ, মোস্তাফিজুর রহমান ও আবু শাহরিয়ার সোহাগ নথি উপস্থাপন করেন। বিভিন্ন কর্মকর্তাদের ভাষ্য অনুযায়ী ব্যাংকে মার্কেটিং অফিসার পদ হিসাবে কোনো পদ না থাকা সত্বেও নথি উপস্থাপনকারীরা মার্কেটিং অফিসার হিসেবে বিপুল সংখ্যক লোকদের অস্থায়ী নিয়োগের সুপারিশ করে এবং উক্ত মার্কেটিং অফিসাররা ০১ বছর কর্মসম্পাদনের মধ্যেই আবার স্থায়ী পদের বিপরীতে নিয়মবহির্ভুতভাবে নিয়োগ পান। যে পরিমাণ লোক স্থায়ী করা হয়েছে তা ব্যাংকের অনুমোদিত সাংগঠিনিক কাঠামো থেকে অনেক বেশি, যার প্রভাবে নিচের গ্রেডের কর্মকর্তা/কর্মচারীরা এখন অনেক বেশি। আবার আরেকটি বিষয় লক্ষ্যনীয় যে, স্থায়ীকৃতদের সুকৌশলে যাতে উপরে পদে পদোন্নতি দেয়া যায় সেজন্যে পদোন্নতি নীতিমালা নমনীয় করা হয়েছে। যেমন: জুনিয়র অফিসার থেকে অফিসার পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে চাকুরিকাল ২(দুই) বছর করা হয়েছে। এই নমনীয় নীতিমালার আওতায় অনেকেই এখন অফিসার বা সিনিয়র অফিসার পদে পদোন্নতি প্রাপ্ত হয়েছেন। অথচ অফিসার বা সিনিয়র অফিসার পদে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে একজন প্রার্থিকে শিক্ষাগত যোগ্যতায় একটি বা দুইটি প্রথম শ্রেণি থাকার পাশাপাশি প্রতিযোগিতামূলক নিয়োগ পরীক্ষায় পাশ হয়ে আসতে হয়। উল্লিখিত অস্থায়ী থেকে স্থায়ীদের অনেকেরই শিক্ষাগত যোগ্যতা বা সনদপত্রের সঠিকতা নাই। সুতরাং, ২০১১ থেকে ২০২০ পর্যন্ত সকল অস্থায়ীদের নিয়োগদানের বিষয়টি পর্যালোচনা করলে ভয়ঙ্কর চিত্র পাওয়া যাবে বলে যানা যায়।
সিনিয়ক কয়েকজন কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ২০১১ সালে আব্দুল্লাহ আল অদুদ যথাযথ নিয়ম না মেনে এ ব্যাংকে নিয়োগ পান। এক্ষেত্রে তাকে সহযোগীয়তা করেন এ ব্যাংকের তৎকালীন আওয়ামীলীগের আদিস্টপুস্ট ব্যাংকের পরিচালক এডভোকেট আব্দুস সালাম। এজন্য নগত অর্থের লেনদেন হয়েছে বলে শোনা যায়। আব্দুস সালাম তার মেয়েসহ মানিকগঞ্জের অনেককেই নিয়ম বর্হিভুত ভাবে ব্যাংকে অফিসার বা সিনিয়র অফিসার পদে নিয়োগ দিয়েছেন বলে কথিত আছে। বর্তমানে তাদের নিয়োগের কোনো প্রমাণকই এখন ব্যাংকে নেই।
অপসারিত ব্যাংকের এমডি মো: জাহাঙ্গীর নিরীক্ষায় গুরুতর আপত্তি থাকা তার অতীব ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি মো: মাজেদুল ইসলাম ও রেজাউল ইসলাম, এসপিও কে পদোন্নতি দিয়েছেন। মো: মাজেদুল ও রেজাউল ইসলাম এসপিও পদে রাজারবাগ শাখা, ঢাকায় শাখা ব্যবস্থাপক থাকাকালীন নিয়মবহির্ভূতভাবে কয়েকেটি পার্সোনাল লোন দেন যা ব্যাংকের অভ্যন্তরীন নিরীক্ষায় প্রতিবেদনে আসে। এছাড়া তার ঘনিষ্ঠ মো: নুরুল ইসলামকে ব্যাংকিং ডিপ্লোমা প্রথমপর্ব বিবেচনায় নিয়ে এসপিও পদে ২০২২ সালে পদোন্নতি দেন। এছাড়া, মো: মাহমুদুল ইসলামকে তিনি এজিএম করেন যে মাহমুদুল ইসলাম তার বোনের জামাইকে অবৈধভাবে এ ব্যাংকে নিয়োগ দিয়েছেন।
বেনামী জামানতে আরবিটেক্স লিমিটেড-কে বিপুল পরিমাণে ঋণ দিয়েছেন মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর। আগস্ট ২০২৪এর পূর্বে শিল্প ঋণ বিভাগের মাধ্যমে ওরিয়ন গ্রুপকে বিশাল অংকের ঋণ অনুমোদন দিয়েছে। এছাড়া এমডি জাহাঙ্গীর এর নামে আরো অনেক দুর্নীতি, অপকর্ম, ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ সর্ব জন স্বীকৃত। ব্যাংক তথা দেশের স্বার্থে স্বাধীনতা ব্যাংকার্স পরিষদসহ আওয়ামী দোসর ও ফ্যাসিস্টদের চিহ্নিত করে সকলকে বিচারের আওতায় আনা জরুরী এমনকি জাহাঙ্গীরের সময়ে সকল পদোন্নতি বাতিল করে যোগ্য, মেধাবী ও বঞ্চিতদের যথাযথ মূল্যায়ন করে অতি দ্রূত পদায়নের ব্যবস্থা গ্রহণ সময়ের দাবী বলে জানান বঞ্চিতরা।