ইতিহাসে কিছু মানুষ থাকেন, যাদের জন্ম কেবল এক সময়ের জন্য নয়—পুরো একটি যুগের জন্য। মাওলানা আবুল আলা মওদুদী ছিলেন এমন এক বিরল মানুষ, যার কলম শব্দের চেয়ে ধারালো, যার চিন্তা সময়ের চেয়ে অগ্রসর, এবং যার যুক্তি বিশ্বাসকে বুদ্ধির সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছিল এক অসাধারণ শক্তিতে।
তার লেখায় ছিল না শুধু ধর্মীয় আবেগ, ছিল এক প্রখর বিশ্লেষণী বুদ্ধি, যা ইসলামী আদর্শকে আধুনিক সমাজ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোয় বিশ্লেষণ করেছে। একদিকে তিনি ধর্মের গভীর ব্যাখ্যা দিয়েছেন, অন্যদিকে রাজনীতিকে দিয়েছেন নৈতিকতার মাপকাঠি। তার কলমে ছিল চিন্তার এমন জ্যোতি, যা একদিকে তর্কের তীব্রতা আর অন্যদিকে বিশ্বাসের কোমলতাকে এক সূত্রে গেঁথে ফেলেছিল।
ভারতবর্ষের বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাসে মওদুদী একা ও অনন্য। ধর্ম ও আধুনিকতার সংঘর্ষে তিনি ছিলেন সেই বিরল কণ্ঠ, যিনি দুই প্রান্তের মাঝখানে এক বুদ্ধিদীপ্ত সেতুবন্ধন তৈরি করেছিলেন। নারীবাদ, সভ্যতার মূল্যবোধ, ইসলামী নৈতিকতা—সবকিছুর ওপর তার লেখার গভীরতা আজও প্রাসঙ্গিক। পশ্চিমা নারীবাদের অন্ধ অনুকরণের বিপরীতে তিনি দেখিয়েছিলেন, ইসলাম নারীকে যে মর্যাদা দিয়েছে তা কোনো সভ্যতাই দিতে পারেনি; সেই বিশ্লেষণে ছিল যুক্তির দৃঢ়তা, ভাষার সাহস এবং বিশ্বাসের মর্যাদা।
তবুও মওদুদী ছিলেন মানুষ—তাঁরও ভুল ছিল। কিছু অবস্থান, কিছু রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ইতিহাসে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। কিন্তু ভুল তাঁর মহত্ত্ব মুছে দেয়নি; বরং সেই ভুলই তাঁকে মানুষ করে তুলেছে, দেবতা নয়। ইতিহাসে তাঁকে বিচার করতে হলে দেখতে হবে তাঁর প্রভাব, তাঁর ভাবনার স্থায়িত্ব, এবং সেই কলমের শক্তি, যা এখনও ইসলামিক রাজনৈতিক দর্শনের ভিত্তি হিসেবে টিকে আছে।
আজকের বাস্তবতা ভিন্ন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ভাবধারার উত্তরসূরিরা—বর্তমান জামায়াতে ইসলামী—আদর্শের জায়গা থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। মওদুদীর যে দৃঢ়তা, যে আদর্শিক সততা, তা আজ ক্ষমতার রাজনীতির কৌশলে হারিয়ে গেছে। তাঁর কল্পিত সমাজব্যবস্থা ছিল নৈতিকতার ওপর দাঁড়ানো এক সভ্যতা; আজ তা কেবল স্লোগান আর প্রতীকে সীমাবদ্ধ।
তবু মওদুদীকে অস্বীকার করা যায় না। তাঁর কলম ইতিহাসের পাতায় এখনো জ্বলজ্বল করে, তাঁর চিন্তা আজও তরুণ মনকে প্রশ্ন করতে শেখায়। তিনি প্রমাণ করেছিলেন—একটি কলম, যদি সত্য ও যুক্তির পক্ষে নিবেদিত হয়, তবে তা বন্দুকের গর্জনের চেয়েও শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
সমালোচনা তাকে থামাতে পারেনি, বরং সময় যত গেছে, তাঁর লেখা তত গভীর হয়েছে। কারণ তাঁর চিন্তা কোনো নির্দিষ্ট যুগের নয়, এটি সেই চিরন্তন তর্ক, যেখানে নৈতিকতা, ধর্ম, ও মানবিকতার সংঘর্ষে জন্ম নেয় নতুন এক সভ্যতার আলো।
আজ যখন সমাজে মতাদর্শ ভাঙছে, ধর্ম রাজনীতির অলঙ্কার হয়ে পড়ছে, তখন মওদুদীর কলম মনে করিয়ে দেয়—আদর্শ কোনো পোশাক নয়, এটি চরিত্রের স্থায়ী গঠন। ভুল ছিল তাঁর, কিন্তু তাঁর মতো কলম আজও এই উপমহাদেশে আর জন্মায়নি।
তার কলমের প্রতিটি অক্ষর যেন প্রশ্ন করে—“তোমরা যারা আমার উত্তরাধিকার দাবি করো, তোমাদের হাতে কি এখনো সেই সাহস আছে, যে সাহস দিয়ে আমি সত্যকে লিখেছিলাম?”
ইতিহাস হয়তো নীরবে উত্তর দেবে—“না, মওদুদীর মতো কলম আজও আর কেউ ধরতে পারেনি।”
জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান
শিক্ষার্থী, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়
কায়রো, মিশর