বাংলার প্রতিচ্ছবি : আমি অনেক সময় ভাবি, তোমার সামান্য ছাড়ে তোমার দাদার জীবনটা অনেক ভালো হতে পারত। হয়ত সুখী হতো সে। আর সুখী হলে মানুষের মধ্যে অস্থিরতা থাকার কথা না। তুমি যতটা বিলাসী জীবন পেয়েছ ততটা পেতে না, আবার পেতেও পারতে। তোমার দাদা তো মেধাবী মানুষ, ভালো রেজাল্ট, কিন্তু এই যে কোনো চাকরিতেই মন লাগাতে না পারা, কী করবে সিদ্ধান্ত নিতে না পারা, ভারাক্রান্ত মনে একবার এদিকে তো আরেকবার ওদিকে ছোটা এগুলো তো অসুখী মানুষই করে? আমাদের সংসার তো অল্প সময়ের মধ্যেই জঞ্জাল হয়ে উঠেছিল তার কাছে। জঞ্জাল নিয়ে কে পড়ে থাকতে চায়? তখন তোমার দাদার খুব ইচ্ছে হতো আবার ব্যাচেলর হয়ে যেতে। ততদিনে মঞ্জুর জন্ম না হলে কী হতো জানি না, হয়ত পালিয়ে যেত।
আবার নাও হতে পারে, জীবনের কাছে সৃষ্টির কাছে বা যদি বলি প্রকৃতির কাছে সব মানুষই যে বিভিন্নভাবে অসহায়—এমনকি ক্ষুদ্র মৌমাছি কাকের কাছে, প্রজাপতি ছোটো ছেলেমেয়েদের কাছে, বনের হরিণ বাঘের বা হরিণ শিকারির কাছে, আবার শিকারিও কোথাও না কোথাও তেমনি অসহায়। এইসব পর্যবেক্ষণের কথা সে তার লেখায় বারবার নিয়ে এসেছে। তার গল্পের নায়িকা উমা স্বামীর দীর্ঘ বেকারত্ব সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করে—আমি এই অংশটির সাথে আমার জীবনের হুবহু মিল পাই। আমিও আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলাম। তোমার দাদা ওই পরিস্থিতিতে আমার যে আত্মহত্যাই করার কথা তা অনুভব করেছে বলেই নিশ্চয়ই গল্পে উমাকে সেভাবেই এঁকেছে, আর উমার স্বামী অনুভব তার নিজেরই অনুভব। সেই অনুভব হলো ‘জীবন এরকমই’—এই অনুভব নিয়েই সে চলেছে তার নিজের মতো করে। কিন্তু দেখো আমি কিন্তু উমার মতো আত্মহত্যা করিনি। আমি জীবন এরকমই মেনে নিয়ে অসহায়ভাবে নিশ্চেষ্ট বসেও থাকিনি। আমি ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য নিরন্তর লড়াই করে গেছি।
তুমি নাকি প্রাণের মানুষ। তড়িঘড়ি আমাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্তটা তোমাকে ভোলার জন্যই নেয়া—এ শুধু আমি এখন বলছি না আরও অনেকেই বলেছে। তাদেরই দেয়া তথ্য অনুযায়ী—তুমি সরে পড়ার সেই সময়টায় প্রবল একাকিত্ব থেকে মুক্তি পেতে সে গিয়েছিল পতিতাপল্লীতে। কিন্তু আমার ধারণা সেটাও জীবন নিয়ে কবি জীবনানন্দের নিরীক্ষা। কবি জীবনানন্দ তার পূর্বসূরিদের মতো প্লেটোনিক ছিলেন না, কবিতায় অশ্লীলতার অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে, ঠিক কিনা? তাই আমার এটাই বিশ্বাস যে পতিতাপল্লী সম্পর্কে সেই সময়ে যে ট্যাবু ছিল তার বিপরীতে গিয়ে তিনি অভিজ্ঞতা নিতে চেয়েছিলেন এবং তা শুধুমাত্র সামগ্রিকভাবে পতিতাপল্লী এবং পতিতার মনের গঠন সম্পর্কিত অভিজ্ঞতাই। যদি যৌনতার জন্য যেতেন তাহলে সেই অভ্যাস থেকেই যেত আর যতই দূরত্ব থাক আমি জেনেই যেতাম। তাছাড়া তোমার দাদার যে রুচিবোধ তাতে সেটা সম্ভবও ছিল না।
আগেই বলেছি আমার বিশ্বাস তোমার দাদা আমাকে পরীক্ষামূলকভাবে বিয়ে করেছিল। যখন বুঝে গিয়েছে তুমি তাকে বিয়ে করবে না অথচ বাড়িতে বিয়ের চাপ তার নিজেরও শরীরের চাহিদা প্রবল সুতরাং সুন্দরী আমাকে দেখে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো বিয়ে করার। এরপর আমাকে কোনোরকম দেখেই করে ফেললো বিয়ে। হয়ত ভেবেছিল শরীর কাছে টানবে, শরীর ভোলাবে সব জ্বালা। কিন্তু আমি যে মানুষ আমার কাছ থেকে পেতে হলে আমাকেও যে দেবার দায়িত্ব আছে তা কী করে ভুলে গেল সে? নারী যে শুধুই দেহ নয় আরেকটি সম্পূর্ণ মানুষ, ভালোবাসা পেতে হলে তাকেও ভালোবাসতে হবে—এটি সেই সময়ের সাধারণ মানুষেরা মানতো না। কিন্তু তোমার দাদা কি সাধারণ মানুষ? আমার শাশুড়ি তার ডায়েরিতে শ্বশুর সম্পর্কে লিখেছেন, ‘চিরজীবনের বন্ধু, সুহৃদ, একমাত্র পরামর্শদাতা, জীবন গঠনের নিয়ন্তা—সুখ-দুঃখের সাথি। পরম প্রেম দিয়া সতত রক্ষা করিতেছেন।’ আর তোমার দাদা কী করেছেন? মাতৃভক্ত ছেলে সে। সংসারের জন্য মায়ের ত্যাগ দেখেছে, প্রাণপাত পরিশ্রম দেখেছে কিন্তু তার পেছনের প্রেমটা দেখেনি? আমার শ্বশুর শাশুড়ি পারস্পরিক পছন্দে বিয়ে করেছিলেন। একই আদর্শ তাদের। সংসারের চালিকাশক্তি ছিল সেই প্রেম। সে তা বুঝবে না তাতো হতে পারে না।
আমাকে গ্রামে ফেলে যে কলকাতায় বসে থাকত বা কাছে যখন থাকত তখনও সারাদিন পড়ার টেবিলে কাটাতে পারত—সে তো আমি তার লেখাকে গুরুত্ব দিতাম বলেই নাকি? আমি সবসময়েই চেয়েছি সে কাজ করুক, সম্মান অর্জন করুক। সে সম্মানিত হলে আমারই তো ভালো লাগার কথা সবচেয়ে বেশি তাই না? রাগারাগি যে হতো সেটাও তো তার কুঁড়েমির জন্যই। যদিও সত্যিকারভাবে কুঁড়ে সে ছিল না। সারাদিনই পড়ত বা লিখত কিন্তু উপার্জন বিমুখ, প্রচার বিমুখ মানুষ কতটাই বা মূল্যায়িত হয় সমাজে? শুধু আমিই কি তাকে অবমূল্যায়ন করেছি? তুমি করোনি? পরিবারের প্রতিটি মানুষ করেনি? গবেষকরা বলে, বাসর রাত থেকে আমার বরিশালে বসবাসের পুরোটা সময় তোমার দাদা তোমার পেছন পেছন ঘুরেছে। একবার মন স্থির করে বরিশাল আসে আবার কলকাতা গেলেই নাকি তুমি মাথায় চেপে বসো। তুমি কলেজে যখন পড়তে তখনও তো বার বার গিয়েছে তাই না? তোমার চরম অবহেলার জন্য অবশ্য তোমাকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়নি।
তাকে অবহেলা করেছেন এমনকি আমার শাশুড়িও। তিনি ভেবুল ঠাকুরপোকে যতটা গুরুত্ব দিতেন তোমার মিলুদাকে তা কখনোই দেননি। দেবেনও বা কী করে; দায়িত্বের কথা, কাজের কথা সব তো ভেবুল ঠাকুরপোর সাথেই বলতে হতো। আমাদের সংসারও তিনিই চালাতেন বলা যায়। প্রতিটি পল আমি তা দেখেছি আর মরমে মরেছি। যে মানুষ বেকার, স্ত্রী-কন্যাসহ অন্যের অর্থে প্রতিপালিত, পরিবারে প্রায় অস্তিত্বহীন তার স্ত্রীর দুরবস্থার কোনো সীমা থাকে? আমার শাশুড়ি শিক্ষিত এবং কবি হওয়া সত্ত্বেও আমার ব্যক্তি স্বাধীনতায় বার বার হস্তক্ষেপ করতেন। বেড়াতে যাচ্ছি কটা কাপড় নেব এ নিয়েও তিনি নাক গলাতেন। প্রতিবাদ করলে রাগারাগি হতো। এ রকমটি আমার জা নিনির বেলায় কখনো ঘটেনি। তার বেলায় অন্য এক মানুষকে দেখেছি। শাশুড়ি মাকে আমি খারাপ বলছি না, আদরও তিনি করেছেন। বলছি সেই সময়টির কথা, স্থান-কাল-পাত্রভেদে দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যাবার কথা। সেই সময়টা তেমনই ছিল যখন কিনা মেয়েদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য তেমন স্পষ্ট করে মান্য করার মানসিকতা তৈরি হয়নি। এগুলো আমার মনগড়া কথা নয়। তোমার উক্তিই তা প্রমাণ করে।
ইউরোপীয় প্রভাবে বইপত্রে মেয়েদের সম্মান করার ব্যাপারটা আছে কথাবার্তায়ও সুসভ্য মানুষেরা তেমনিই বলতেন, কিন্তু তার চর্চাটি তেমন করে ছিল না। তোমার দাদাও প্রচুর বিদেশি সাহিত্য পড়েছিল বলেই হয়ত কবিতায় ও সাহিত্যভাবনায় আধুনিকমনস্ক ছিলেন। তার গল্প-উপন্যাসের নায়ক নায়িকারা তো খুবই আধুনিক। যদিও তাতে আমার কোনো উপকার হয়নি। আমি যে তাকে পছন্দ করিনি, বিয়েতে যে আমার আগ্রহ নেই তা সে বুঝে নিয়েছিল। কিন্তু সমাজের সাধারণ মানুষের মতোই সে ধরেই নিয়েছিল আমার মতো সুন্দরী তার অস্থিরতা, অতৃপ্ত যৌনকামনা সব ঠিক করে ফেলতে পারবে। কবি সাহিত্যিক অনেকেই তেমনই ছিল। কিন্তু তোমার দাদার মতো সংবেদনশীল মানুষও নারীর প্রতি প্রায় একইরকম মনোভঙ্গি পোষণ করত এটাই আশ্চর্যের!
তোমার দাদার একটা কথা আছে ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’ তা তোমার দাদা তো জাত কবি। তার কবিতার পদে পদে সে যে দর্শন লিপিবদ্ধ করেছে তাতে প্রেম আর প্রেমহীনতা, শূন্যতা, জীবনের নিগূঢ় অসারতা সবই তো আছে তাহলে সবাই মিলে কেন আমাকেই ভিলেন বানালো? তুমি যেমন তার মৃত্যুর জন্য একমাত্র আমাকেই দায়ী করলে। অশালীনভাবে বললে— ‘ওর স্ত্রী তো ভয়ংকর, ওর উপযুক্ত পাত্রী ছিল না, মিলুদাকে ভাজাপোড়া করে ছেড়েছে’ আরও অনেক কিছুই বললে। তারপর সেই ঐতিহাসিক উক্তি ‘ঢাকার মেয়েরা এমনি জ্যান্ত খেকো হয়’—একবারও ভাবনি এই ভাষ্য আমাকে কোথায় পৌঁছে দিতে পারে। মানবিকতার মাপকাঠিতে তোমাকে কোথায় রাখা যায় বলো দেখি? তুমি এক কথায় যেমন করলে তেমনি করল অন্য কবি লেখক আর তোমার দাদার ভক্তরা। এভাবে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো খুব সহজ তাই সেই সহজ পথটাই সকলে বেছে নিয়েছিল।