বাংলার প্রতিচ্ছবি : নর্দান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের (এনইউবি) ট্রাস্টি ইস্যুতে গঠিত তদন্ত কমিটি ও তাদের জমাদানকৃত প্রতিবেদন নিয়ে নতুন আলোচনা সামনে এসেছে। বর্তমান ট্রাস্ট্রির দাবি, কমিটির আহ্বায়কের নিরপেক্ষতা ইতোমধ্যেই প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ হিসেবে তাদের বক্তব্য, সাবেক সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ আলতাফ হোসাইন তৎকালীন ট্রাস্টি বোর্ড থেকে পদত্যাগকারীদের পূর্বপরিচিত। প্রতিবেদন নিয়ে স্বচ্ছতার প্রশ্ন তোলার পাশাপাশি অনিয়মের অভিযোগও করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তথ্যমতে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময় থেকেই এনইউবি’র ট্রাস্ট্রি মালিকানা দাবি করে আসছেন প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাকালীন কয়েকজন উদ্যোক্তা। দাবির প্রেক্ষিতে একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)। সম্প্রতি সেই কমিটি ইউজিসি বরাবর তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। যদিও অভিযোগ উঠেছে, জমাকৃত ওই তদন্ত প্রতিবেদনে শুধু আহ্বায়কের সাক্ষর রয়েছে। প্রতিবেদনটির ফরওয়ার্ডিং পেজেও বিষয়টির সত্যতা মিলেছে।
ইউজিসি বলছে, স্বচ্ছতা বজায় রেখেই তদন্ত কমিটি কাজ করার চেষ্টা করেছে। পাশাপাশি বিতর্কের যে বিষয়গুলো আসছে, সেটিও দেখা হচ্ছে। আর তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক সাবেক সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ আলতাফ হোসাইন জানান, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন বর্তমান ট্রাস্ট্রিদের বিপক্ষে যাওয়ার কারণেই অনিয়মের অভিযোগ তোলা হচ্ছে। এ সময় তিনি দাবি করেন, আগের ট্রাস্টিতে থাকা লুৎফর রহমান ও বোরহান উদ্দিনকে তিনি চেনেন না।
বর্তমান ট্রাস্ট্রিরা জানান, ২০১১ সালে এনইউবি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ বাস্তবায়নে ব্যর্থ হলে এবং আর্থিক সংকটে পড়লে তৎকালীন ট্রাস্টি বোর্ডের অধিকাংশ সদস্য আইন অনুযায়ী পদত্যাগ করেন। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন লুৎফর রহমান ও বোরহান উদ্দিন। পরবর্তীতে গঠিত নতুন ট্রাস্টি বোর্ড দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করে আসছে। কিন্তু ৫ আগস্টের পর হঠাৎ করেই নিজেদের এনইউবির ট্রাস্টি হিসেবে পরিচয় দিয়ে সক্রিয় হয়ে ওঠেন আগের একটি গ্রুপ। বিভিন্ন ফোরামে তারা এনইউবি পরিচালনায় পুনঃঅধিকার দাবি করেন।
অভিযোগ রয়েছে, ইউজিসি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে একাধিক অভিযোগ দাখিল করে তদন্ত কমিটি গঠনের দাবি জানান লুৎফর রহমান ও বোরহান উদ্দিন। ফলে ইউজিসি থেকে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়। তবে তৎকালীন ট্রাস্টি বোর্ড থেকে পদত্যাগকারীদের সঙ্গে যোগসাজশে ইউজিসির এক দায়িত্বশীলও বর্তমান ট্রাস্ট্রিদের উৎখাতের অপচেষ্টায় জড়িয়ে পড়েন। ফলে কমিটিতে স্থান পায় বিতর্কিতরা।
জানা যায়, লুৎফর রহমান ও বোরহান উদ্দিনের প্ররোচনায় শুরুতে শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আবু নোমান মো. ফারুক আহমেদকে তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে প্রস্তাব করে ইউজিসি। পরে অভিযোগ ওঠে, ড. নোমান ফারুক সরাসরি অভিযোগদাতাদের ঘনিষ্ঠজন। শুধু তাই নয়, তিনি নর্দান ইন্টারন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ অ্যান্ড হসপিটালের গভর্নিং বডির সদস্য পদেও সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছিলেন।
বিষয়টি প্রকাশ্যে আসলে এনইউবির বর্তমান ট্রাস্টি বোর্ড ইউজিসি চেয়ারম্যানকে বিষয়টি লিখিতভাবে জানান। এরপরই ইউজিসি ড. নোমান ফারুককে তদন্ত কমিটি থেকে বাদ দেয়। নতুন আহ্বায়ক করা হয় সাবেক সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ আলতাফ হোসাইন। যদিও এরপরও অভিযোগ, আগের আহ্বায়কের মত আলতাফ হোসাইনেরও আগের ট্রাস্ট্রি লুৎফর রহমান ও বোরহান উদ্দিনের পূর্বপরিচিত এবং নিজ এলাকার। বিগত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী শাসনামলে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সচিব হিসেবেও কাজ করেছেন আলতাফ হোসেন।
বিষয়গুলো সম্পর্কে জানতে চাইলে নর্দান ইউনিভার্সিটির ডেপুটি রেজিস্ট্রার ড. একরাম উদ্দিন বলেন, “কমিটিকে কেন্দ্র করে যেসব অভিযোগ ও তথ্য উঠে এসেছে, তা গভীর উদ্বেগের। নর্দান ইউনিভার্সিটি স্বনামধন্য বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে শিক্ষার গুণগত মান, নৈতিকতা এবং প্রশাসনিক স্বচ্ছতার প্রতি সর্বোচ্চ অঙ্গীকারবদ্ধ। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, শিক্ষা খাতে যেকোনো অনিয়ম বা দুর্নীতি রোধে আইনানুগ এবং নিরপেক্ষ তদন্ত অত্যন্ত জরুরি।’’
তিনি বলেন, যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী তদন্ত প্রক্রিয়ায় প্রভাব বিস্তার, পক্ষপাত বা অনৈতিক অর্থ লেনদেনের সঙ্গে জড়িত থাকেন, তাহলে সেটি অত্যন্ত নিন্দনীয় এবং দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার জন্য হুমকিস্বরূপ। আমরা চাই, ইউজিসি বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নিয়ে একটি স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও বহুপক্ষীয় তদন্ত কমিটির মাধ্যমে পুনঃতদন্ত পরিচালনা করুক, যাতে সত্য উদঘাটিত হয় এবং দোষীরা জবাবদিহির আওতায় আসে।
ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আলতাফ হোসেন কখন কোথায় ক্লাস নিচ্ছেন সেটি তার ব্যক্তিগত বিষয়। উনি যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন; সেটা নিয়ে আমরা স্বচ্ছতা বজায় রেখেই কাজ করছি। ন্যূনতম বিতর্ক যেন না ওঠে, সে বিষয়ে আমরা সজাগ রয়েছি।’ চলতি অথবা আগামী সপ্তাহে নর্দান ইউনিভার্সিটির তদন্ত প্রতিবেদন সরকারের কাছে পাঠানো হবে বলেও জানান তিনি।