Saturday, September 21, 2024
Google search engine
Homeদেশসংবিধান চেয়ে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার প্রয়োজন: সারা হোসেন

সংবিধান চেয়ে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার প্রয়োজন: সারা হোসেন

নারীর প্রতি বৈষম্য, ধর্ষণ, নিপীড়ন ও নারী নির্যাতনের প্রতিবাদ এবং সংবিধানের নারী-পুরুষ সমতা নিশ্চিতের দাবিতে মধ্য রাতে ঢাকায় ‘শেকল ভাঙার পদযাত্রা’ করেছেন নারীরা। এ পদযাত্রায় বিভিন্ন শ্রেণিপেশার নারীরা অংশগ্রহণ করে নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করার দাবি জানান।

তারা বলেন, বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে নারীর প্রতি দমন, নিপীড়ন ও নির্যাতনের কালচার চলে আসছে। সংবিধানের নারীর অধিকার ও সমতা নিশ্চিত করতে হবে। প্রশাসন-বিচার বিভাগসহ রাষ্ট্রের প্রতিটা প্রতিষ্ঠানে নারী নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

শুক্রবার (৩০ আগস্ট) রাত ১২টা ৫ মিনিটে শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সামনে থেকে শেকল ভাঙার গণ পদযাত্রাটি শুরু হয়। ধর্ষণ ও নারী নিপীড়নের প্রতিবাদ এবং অপরাধীদের বিচারের দাবিতে এই প্রতিবাদ পদযাত্রা।

এটি শাহবাগ থেকে সিটি কলেজ-কলাবাগান হয়ে মানিক মিয়া এভিনিউ গিয়ে শেষ হয়। রাত আড়াইটার দিকে মানিক মিয়া এভিনিউতে পৌঁছে সমাবেশ করেন তারা। মানিক মিয়া এভিনিউ সড়কে জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় সামনে এসে শেকল ভাঙার পদযাত্রা থামে। এ সময় শেকল ভাঙার পদযাত্রা আয়োজক প্রাপ্তি তাপসী ১৩টি লিখিত দাবি ঘোষণা করেন। পরে কণ্ঠশিল্পী ফারজানা ওয়াহিদ সায়ানের ‘সাহস করো মা-বোনেরা’ গান পরিবেশনার মধ্য দিয়ে শেষ করা হয়।

সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী সারা হোসেন বলেন, ‘আমরা এই মুহূর্তে সংবিধান পরিবর্তনের কথা ভাবছি না। আমার কাছে মনে হয়, সংবিধান প্রণয়নের চেয়ে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার প্রয়োজন। বিশেষ করে বিচার বিভাগীয়, মানবাধিকার কমিশন, নির্বাচন কমিশনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে আমাদের ভাবা ও কাজ করা উচিত।’

তিনি আরও বলেন, ‘এই যে আজকে রাতে আমরা হেঁটে এসেছি, অনেক নারী আসার কথা ছিল। অথচ নিরাপত্তার কারণে বাসা থেকে আসতে দেওয়া হচ্ছে না। সেই জায়গাগুলোতেও আমাদের কাজ করতে হবে। যাতে করে আমরা গণতান্ত্রিকভাবে সবাই অংশগ্রহণ করতে পারি। এই সময়েও যে বিভিন্ন সুপারিশ আসবে, সংস্কারের যে বিভিন্ন প্রক্রিয়া চলবে- সেখানে নারীদের অংশগ্রহণ দেখতে চাচ্ছি।’

বাংলাদেশ নারী মুক্তি কেন্দ্রের সভাপতি সীমা দত্ত বলেন, ‘সরকার পতনের পরও তিন পার্বত্য জেলায় ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। গত দুই দিন আগেও একটি মাদ্রাসা ছাত্রীকে ধর্ষণ করেছে। ফলে নারীর প্রতি নির্যাতনের ঘটনা থেমে নেই। তাই আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবিতে আজকের পথযাত্রা। যেহেতু এই সরকার আমাদের ছাত্র-জনতার সরকার। আমরা চাই, এই সরকার নারী-পুরুষের সমতা নিশ্চিত করবে। আমরা চাইবো, নারীর প্রতি কোনও বৈষম্য হবে না। এটাই রাষ্ট্রের কাছে নিশ্চিত করতে চাই।’

শেকল ভাঙার পদযাত্রার আয়োজক প্রাপ্তি তাপসী বলেন, ‘২০২০ সালে ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে আমরা প্রথম শেকল ভাঙার পদযাত্রার আয়োজন করি। এবার চতুর্থবারের মতো আমাদের এই পদযাত্রা। জুলাই গণঅভ্যুত্থান, হাজার হাজার শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা যে স্বৈরাচার মুক্ত দেশ পেয়েছি, সেই দেশে মুক্ত হবে না ততদিন পর্যন্ত যতদিন এই দেশের নারীরা পদে পদে নিপীড়িত হতে থাকবে। ড. ইউনূসের নেতৃত্বে যে সরকার গঠন হয়েছে আমরা আশা করি এই সরকার নারীদের নিরাপত্তা এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে। মুনিয়া ধর্ষণ ও হত্যা মামলা থেকে শুরু করে যত বিত্তশালীরা এতদিন পার পেয়ে গেছে, তারা যেন এখন আর না পায়।’

পদযাত্রায় অংশগ্রহণকারী নারীরা বিভিন্ন স্লোগান দেন ও তাদের হাতে বিভিন্ন প্ল্যাকার্ডে পুরুষের ক্ষমতা ভেঙে হোক সমতা, আইনসিদ্ধ নিপীড়ন বন্ধ হোক, বম নারীদের নিপীড়ন বন্ধ করো, স্টপ স্টেট প্রডিউসড ভায়োলেন্স, বিত্তবানদের অপরাধ লুকানো বন্ধ করো, রক্ত দিলো জনতা এবার চাই সমতা, ঘুম ভাঙানি মাসি পিসি চলো পুরুষতন্ত্র পিষি, হাতে হাতে মশাল জ্বালো নারী তুমি কথা বলো, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, ধর্ষক কি পাবে পার?, কল্পনা চামকা কোথায়? নারী আন্দোলনকারী সামনে নাই কেন? আমার বোন কবরে, আনভীর কেন বাইরে? ইত্যাদি লেখা প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করে। এ সময় তাদের অনেকের হাতে মশাল ছিল।

তাদের ১৩ দাবি হলো-
১। সারা দেশে অব্যাহত ধর্ষণ-যৌন সহিংসতার সঙ্গে যুক্তদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে দৃষ্টান্তমূলক ও ন্যায্য শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

২। সায়েম সোবহান আনভীর, শাফাত আহমেদের মতো শিল্পপতি-ধনকুবেরদের নারী নিপীড়নমূলক অপরাধ বিচারের আওতায় এনে দ্রুততম সময়ের মধ্যে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে অন্যায্যভাবে খারিজ হয়ে যাওয়া মামলাগুলো পুনঃতদন্তের ব্যবস্থা করতে হবে।

৩। ধর্ষণ মামলার ক্ষেত্রে সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২ (সংশোধিত) এর ১৪৬ (৩) ধারা পুনঃসংস্কার করার মাধ্যমে আইনের দিক সহ জাতি-ধর্ম-বর্ণ-বয়স-লৈঙ্গিক পরিচয় নির্বিশেষে যৌন সহিংসতার ক্ষেত্রে যেকোনোভাবেই ‘ভিক্টিম ব্লেমিং’ (দোষারোপ করা/নিন্দা জানানো) বন্ধ করতে হবে।

৪। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আইনি ও সামাজিকভাবে ধর্ষণের সংজ্ঞায়ন সংস্কার করতে হবে।

৫। মামলার ডিএনএ আইনকে সাক্ষ্য প্রমাণের ক্ষেত্রে কার্যকর করতে হবে।

৬। সেনা প্রহরার পাহাড়ে নারীর ওপর সংঘটিত সামরিক-বেসামরিক পুরুষদের যৌন সন্ত্রাসের খবর গণমাধ্যমে আসার অবাধ প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা, অভিযোগ যথাযথভাবে আমলে নেওয়া ও সুষ্ঠু বিচারের মাধ্যমে পাহাড়ে নারীর জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

৭। হাইকোর্টের নির্দেশনানুযায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সরকারি, বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানে যৌন নির্যাতন বিরোধী সেল কার্যকর ও পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে। সিডো সনদে বাংলাদেশকে স্বাক্ষর ও তার পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে।

৮। যৌন সহিংসতা প্রতিরোধে প্রান্তিক অঞ্চলের নারীদের সুবিধার্থে হটলাইন চালু করতে হবে। গ্রামীণ সালিশ/পঞ্চায়েতের মাধ্যমে ধর্ষণের অভিযোগ ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে হবে।

৯। প্রাথমিক লেভেল থেকেই পাঠ্যপুস্তকে যৌন শিক্ষা (গুড টাচ-ব্যাড টাচের শিক্ষা, সম্মতি বা কনসেন্টের গুরুত্ব, প্রাইভেট পার্টস সম্পর্কে জানানো) যোগ করার সঙ্গে সঙ্গে এর কার্যকরী পাঠদান নিশ্চিত করতে হবে।

১০। মাদ্রাসার শিশুসহ সব শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং কোনও শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হলে ৯০ দিনের মাঝে দ্রুততম ট্রাইব্যুনালে অভিযোগের সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করতে হবে।

১১। কোনও নারী নিপীড়নের শিকার হলে অভিযোগ জানাতে গেলে থানা ও আদালতে পুলিশি ও অন্যান্য হয়রানি বন্ধ করতে হবে।

১২। গণপরিবহনে নারীদের সুরক্ষা এবং নিরাপত্তার বিষয়ে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করতে হবে।

১৩। ধর্মীয় বক্তব্যের নামে অনলাইনে ও অফলাইনে নারী অবমাননাকর বক্তব্য প্রচার বন্ধ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments