Saturday, September 21, 2024
Google search engine
Homeদেশনেই চাঁদাবাজি, শান্তিতে জীবিকা নির্বাহ করছেন দোকানদার ও ড্রাইভাররা

নেই চাঁদাবাজি, শান্তিতে জীবিকা নির্বাহ করছেন দোকানদার ও ড্রাইভাররা

জীবিকার তাগিদে ইট-পাথরের এই শহরে কোটি মানুষের আগমন। পড়াশোনা শেষ করে প্রতিষ্ঠিত হতে কিংবা পারিবারিক সচ্ছলতা ফেরাতে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু মানুষ রাজধানীতে ছুটে আসেন। দিনের পর দিন হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজে বেড়ান বেকার যুবকরা। সংসার চালাতে বাধ্য হয়ে অনেকে শহরের ফুটপাতেই ব্যবসা করেন, আবার কেউবা শ্রমিকের কাজ করেন। কিন্তু সেটিও শান্তি মতো করার উপায় ছিল না রাজধানীর আনাচে-কানাচে চাঁদাবাজির কারণে।

ফুটপাতে কিংবা শহরের যেকোনও জায়গায় দোকান করতে বাধ্য হয়ে চাঁদা দিতে হতো প্রভাবশালীদের। পুলিশ এবং আনসার সদস্যরাও এর বাইরে নন। দিনব্যাপী ব্যবসা করে কিংবা গাড়ি চালিয়ে চাঁদার টাকা দিয়ে নিজের পকেটে খুবই সামান্য পরিমাণ টাকা নিয়ে ফিরতে হতো বাসায়। চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে কারও কিছু বলার সুযোগ ছিল না। কারণ এর বিরোধিতা করলে বা চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালেই তাদের ওপর নেমে আসতো অমানবিক নির্যাতন। কিন্তু সরকার পতনের পরেই আসে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন। এখন ফুটপাতে ব্যবসা করতে কিংবা যানবাহন চালাতে দিতে হয় না কোনও চাঁদা। শিক্ষার্থীদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় রুখে দেওয়া হয়েছে চাঁদাবাজি।

শুক্রবার (৯ আগস্ট) সরেজমিন পুরান ঢাকায় চাঁদাবাজি হচ্ছে কিনা তার খোঁজ নিতে গেলে ফুটপাতের ব্যবসায়ী এবং গাড়ি চালকরা জানান, চাঁদাবাজি নেই, শান্তিতে দোকান করছি, গাড়ি চালাচ্ছি।

পুরান ঢাকার লক্ষীবাজারের ফুটপাতের ব্যবসায়ী সিদ্দিক হোসেন বলেন, এক হাজার টাকার দোকানদারি করলে দুইশো টাকা চাঁদা দিতে হতো। ছাত্রলীগ নেতা পরিচয় দিয়ে বাকি খেয়ে চলে যেতো। মাঝেমধ্যে সারা দিন বেচাকেনা করেও দুই-তিনশো টাকা লাভ হতো না। কেউ কিছু বলতেও পারতো না। সব মুখ বুজে সহ্য করতে হতো। কিন্তু এখন আর কোনও চাঁদা দিতে হচ্ছে না। শিক্ষার্থীরা বলে দিয়েছে কাউকে চাঁদা না দিতে। এখন শান্তিতে দোকান করছি।

শান্তিতে বাস চালাতে পারছেন ড্রাইভার। ছবি: সংগৃহীত

ভিক্টর ক্লাসিক বাসের চালক শাকিল হোসেন বলেন, পুরান ঢাকায় ঢুকলেই ট্রাফিক সার্জেন্টকে দৈনিক ন্যূনতম দুই থেকে তিনশ টাকা চাঁদা দিতে হতো। নয়তো গাড়িকে ১০০০-১২০০ টাকা জরিমানা করতো। কখনও কখনও দুই হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা করতো। আর ছাত্রলীগ বা যুবলীগের নেতাকর্মীদের তো আসতে যেতে ৫০/১০০ টাকা দিতে হতো। কিন্তু এখন আর সেটা দিতে হচ্ছে না। শান্তিতে গাড়ি চালাচ্ছি।

আজমেরী গ্লোরি বাসচালক মো. সিরাজ বলেন, শিক্ষার্থীরা সড়কে থাকার কারণে এখন এক বাস আরেক বাসকে ওভারটেক করে না। বাসে বাসে যে সংঘর্ষ হতো সেটা এখন থেমে গেছে। গাড়ি চালাতে নিরাপদ বোধ করছি। তবে একটা সমস্যা এখন তুলনামূলক যাত্রী কম পাচ্ছি। কারণ ঠিকভাবে কোথাও দাঁড়াতে পারছি না। গাড়ি সব সময় চলমান রাখতে হয়।

লক্ষ্মীবাজার এলাকার ফুটপাতের সবজি দোকানদার শাহেদ আলী জানান, কবি নজরুল কলেজের সামনে দোকান করতে কলেজ ছাত্রলীগের নেতাদের প্রতিদিন ২০০ টাকা করে চাঁদা দিতে হতো। এছাড়া পুলিশ ও আনসারকে ২০ টাকা করে দিতে হতো। এলাকার অনেক নেতা সবজি নিয়ে যেতো কিন্তু টাকা দিতো না। টাকা চাইতে গেলে ধমক দিয়ে বলতো বেশি বাড়াবাড়ি করলে দোকান করতে দেবো না, লাথি মেরে উঠিয়ে দেবো। দোকান করার প্রথম কয়েকদিন চাঁদা না দেওয়ায় কয়েকজন এসে মারধর করেছে।

শাহেদ আলী আরও বলেন, গত এক মাস আন্দোলন সংগ্রামের কারণে ঠিকমতো দোকান করতে পারিনি। কীভাবে খাবো, সংসার চালাবো, বাসা ভাড়া দেবো এই চিন্তায় ছিলাম। মাসের ১০ তারিখের মধ্যে বাসা ভাড়া কেমনে দেবো সেই চিন্তায় ঘুম আসেনি কয়েকদিন। গত কয়েকদিন দোকান করে শান্তি পাচ্ছি। আগের মতো চাঁদা দিতে হচ্ছে না। এই তিন দিনে চাঁদা আর সবজি না দিয়ে অন্তত তিন হাজার টাকা বাঁচাতে পেরেছি। শিক্ষার্থীরা না থাকলে এই সুযোগ আমরা কখনও পেতাম না।

চাঁদাবাজ না থাকায় শান্তিতে দোকান করতে পারছেন তারা। ছবি: সংগৃহীত

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকার চা দোকানদার শামীম বলেন, আমার দোকান থেকে ছাত্রলীগের নেতা পরিচয় দিয়ে অনেকে চা-বিড়ি খেয়ে চলে যেতো। টাকা চাইলে দিতো না। একেক নেতার কাছে অন্তত দুই-আড়াই হাজার টাকা পাওনা। না দিয়েই চলে গেছে, কিছু বলতেও পারিনি। এই কয়দিন বেশ শান্তিতে দোকান করছি। যে-ই খাচ্ছে টাকা দিচ্ছে। কেউ বাকি খাচ্ছে না। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এসে আমাদের বলে গেছেন, কেউ যদি চাঁদা চায় তাহলে ওদের বেঁধে রেখে তাদের খবর দিতে।

মালিবাগ থেকে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে আসা জামাল উদ্দিন নামের একজন সিএনজি চালকের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, আগে মোড়ে মোড়ে ১০-২০ টাকা সিটি টোলের নামে চাঁদা দিতে হতো। সদরঘাটের এই সড়কে বিশেষ করে ভিক্টোরিয়া পার্কের মোড়ে মোড়ে আসা-যাওয়ার সময় চাঁদা দিতে হতো। এখন আর সেটা দিতে হচ্ছে না। সত্যি বলতে এজন্য আমরা যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া কম নিচ্ছি।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তানভীর আহমেদ বলেন, রাজনৈতিক পরিচয় দিয়ে অনেকে দোকানপাটে চাঁদাবাজি করতো। সদরঘাট এলাকায় অনেকে বাস থেকে, সিএনজি থেকে, মালবাহী গাড়ি থেকে চাঁদা নিতো। কিন্তু এখন আর এই চিত্র নেই। আমরা শিক্ষার্থীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে তা প্রতিহত করেছি। আমরা সবাইকে বলে দিয়েছি কেউ যেন একটা টাকাও চাঁদা না দেয়। যে চাঁদা চাইতে আসবে তাকে যেন গণধোলাই দেয়।

কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থী মো. মোস্তফা বলেন, সরকার পতনের পরেও নতুন করে পুরান ঢাকায় অনেকে চাঁদাবাজি শুরু করেছে। আমরা শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে মনিটরিং করছি, কোথায় কে চাঁদাবাজি করছে। গত দুই দিনে আমরা অন্তত ১০ জন চাঁদাবাজকে ধরেছি এবং কান ধরে উঠবস করিয়ে আর কখনও যেন চাঁদাবাজি না করে সেই প্রতিশ্রুতি নিয়ে ছেড়ে দিয়েছি। আমরা এই দেশটাকে চাঁদাবাজমুক্ত করছি। আমরা চাই না এখানে আবার নতুন করে কেউ এসে চাঁদাবাজি করুক।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments