Wednesday, June 26, 2024
Google search engine
Homeজাতীয়বাজেটে ‘আর্থিক ঝুঁকি বিবৃতি’

বাজেটে ‘আর্থিক ঝুঁকি বিবৃতি’

সামষ্টিক অর্থনীতিতে অব্যবস্থাপনা কমিয়ে আনতে প্রথমবারের মতো বাজেটে ‘আর্থিক ঝুঁকি বিবৃতি’ যুক্ত করা হয়েছে। এই বিবৃতিতে সামষ্টিক অর্থনীতি, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকিগুলো বিশ্লেষণ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কারিগরি সহযোগিতা ও প্রতিষ্ঠানটির টুলকিট ব্যবহার করে এই বিবৃতি প্রস্তুত করেছে অর্থ বিভাগ। 

২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ‘মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতি-২০২৪-২৫ হতে ২০২৬-২৭’ এ ঝুঁকি বিবৃতির বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে, যেকোনও দেশের সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় সম্ভাব্য অভিঘাত মোকাবিলায় ‘ঝুঁকি বিশ্লেষণ’ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। 

বিবৃতিতে চার ধরনের ঝুঁকি সম্পর্কে বলা হয়েছে। প্রথমত, সামষ্টিক অর্থনৈতিক ঝুঁকি— যেখানে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়, সুদের হার, সরকারি ব্যয়, বাজেট ঘাটতি, সরকারি ঋণ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। দ্বিতীয়, প্রাতিষ্ঠানিক ঝুঁকি— যেখানে আর্থিক প্রাক্কলন (সম্ভাব্য ব্যয়ের হিসাব) ও পূর্বাভাসের বিচ্যুতি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। তৃতীয়ত, প্রচ্ছন্ন ও পুঞ্জীভূত দায়— যেখানে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের দায় ও রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। চতুর্থত, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি— যেখানে আলোচনা করা হয়েছে দীর্ঘমেয়াদি জলবায়ু ঝুঁকি ও স্বল্পমেয়াদি প্রাকৃতিক ঝুঁকি নিয়ে।

বাজেটে এমন বিবৃতি যুক্ত করার বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ড. মোহাম্মদ সাহাদাত হোসেন সিদ্দিকী বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যে ম্যাক্রো-মিসম্যানেজমেন্টে আছে সেটা সরকার কোভিডের আগে টের পায়নি। কারণ তখন ফরেন কারেন্সি স্ট্যাবল ছিল। একটা দেশ যখন ফরেন কারেন্সিতে ইন-স্ট্যাবল হয়ে যায় তখন সার্বিকভাবে একটা বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। তখন ঝুঁকিটা যে সত্যিই ঝুঁকি, সেটা রাজনীতিকরা স্বীকার করতে বাধ্য হন।’

ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ওই শিক্ষক বলছেন, ‘শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রেও কিন্তু একই ব্যাপার ঘটেছিল। তাদের কোনও কিছুই কিন্তু তেমন পরিবর্তন হয় নাই, শুধু ফরেন কারেন্সিতে ধাক্কা লাগায় পুরো দেশ তলানিতে গিয়েছিল। এখন যদিও রি-ব্যাক করছে। এখন বাংলাদেশের ফরেন কারেন্সিটা যে পর্যায়ে আছে, রাজনীতিকদের ভেতর থেকে এসব কথা আসবে সেটাই স্বাভাবিক।’

‘রিস্ক সব সময়ই মাথার মধ্যে থাকে কিন্তু কোনও অবস্থাতেই লিখিত অবস্থায় আসে না। একটা দেশের ম্যাক্রো-ইকোনমিক ইনস্ট্যাবলিটি যখন সিরিয়াস আকার ধারন করে; তখন শুধু বাংলাদেশের না, পৃথিবীর যেকোনও উন্নয়নশীল দেশ যখন এই ধরনের ক্রাইসিসের মধ্যে পড়ে তখন ফিসক্যাল ম্যানেজমেন্টের (আর্থিক ব্যবস্থাপনা) ওপর গুরুত্ব দিতে গিয়ে বাজেটে এসব ঝুঁকির কথা আসে।’ বলছিলেন ড. মোহাম্মদ সাহাদাত হোসেন সিদ্দিকী।

তিনি আরও যোগ করেন, ‘এই ঝুঁকির বিবেচনাটা মূলত আসছে সামষ্টিক অর্থনীতিতে যে অব্যবস্থাপনা তৈরি হয়েছে সেটা ঠিক করার লক্ষ্যে; এই জায়গাটা লিখিত আকারে একটা ফরমেশনে নিয়ে এসেছে সরকার,  এর চেয়ে আর বেশি কিছু না।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূলত দেশে ডলার সংকটের কারণে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শে অর্থ মন্ত্রণালয় লিখিতভাবে ঝুঁকি বিবৃতি প্রণয়ন করেছে। আন্তর্জাতিক এই প্রতিষ্ঠানটিকে ‘সন্তুষ্ট’  করাও এই লিখিত বিবৃতির লক্ষ্য।

এ প্রসঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সামষ্টিক অর্থনৈতিক অনুবিভাগ) ড. জিয়াউল আবেদীন বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, আর্থিক ঝুঁকি বিশ্লেষণ ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও করা হয়েছে। তবে ‘রিস্ক স্ট্যাটমেন্ট’ হিসেবে প্রথমবার। ফিন্যান্সিয়াল যে ফরমাল অ্যানাইলাইসিস, এটা প্রথমবার শুরু হয়েছে।

এক প্রশ্নের জবাবে ড. জিয়াউল আবেদীন বলেন, ‘এটা আইএমএফ যেভাবে বলেছে সেটা না। রিস্ক অ্যানালাইসিস করতে গেলে, গতবার আমরা যখন করেছি তখন সেটা ফরমাল কোনও টুল ছিল না। রিস্ক অ্যানালাইসিসের ফরমাল টুলটা ডেভেলপ করেছে আইএমএফ। আমরা সেটা ইউজ করেছি। আইএমএফ কিন্তু আমাদের বলে নাই এটা করতে। আমরা নিজেরাই বলেছি যে, এটা আমরা করতে চাই, যে কারণে ওরা (আইএমএফ) আমাদের এই টুলটা দিয়েছে। এবং আমরা যাতে এটা কারেক্টলি ইউজ করতে পারি সেজন্য ওরা (আইএমএফ) আমাদের ট্রেনিংও দিয়েছে।’

কোনও কোনও বিশেষজ্ঞের পর্যবেক্ষণ, ‘আর্থিক ঝুঁকি বিবৃতি’র ইতিবাচক দিক হচ্ছে বাজেটের ওঠানামা হ্রাস করবে। যাতে করে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি দেখা দিলে ঋণ নেওয়ার প্রবণতা কমাবে। নেতিবাচক দিক হচ্ছে, সরকারের দায় মেটানোর বেশিরভাগ প্রভাব পড়বে সরাসরি সাধারণ মানুষের ওপর। প্রচ্ছন্নভাবে সরকার নানা খাতে ভর্তুকি কমাবে।

‘আর্থিক ঝুঁকি বিবৃতি’তে বিশ্লেষণের আলোকে ঝুঁকি প্রশমন নীতি-কৌশল প্রস্তাব করা হয়েছে। সুদের কারণে সরকারি ঋণের সুদ ব্যয় বৃদ্ধি পেলে তা পরিশোধের লক্ষ্যে আর্থিক পরিকল্পনায় বাজেট বরাদ্দের যথাযথ সমন্বয়; বাজেট বরাদ্দে দক্ষতা আনয়নে এবং বাজেটের বড় রকমের সংশোধন কমাতে একটি উপযুক্ত বাজেট পূর্বাভাস পদ্ধতি গ্রহণ করাসহ সেখানে আটটি প্রস্তাবের কথা বলা হয়েছে।

সরকারের প্রচ্ছন্ন ও পুঞ্জীভূত দায়ের ঝুঁকি প্রশমনে এবং একটি টেকসই রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টি ব্যবস্থাপনার জন্য ‘সভেরিন গ্যারান্টি গাইডলাইনস-২০১২’ হালনাগাদ করার প্রস্তাব করা হয়েছে নীতি-কৌশলে। এক্ষেত্রে ‘সভেরিন গ্যারান্টি গাইডলাইনস’-এ কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।

নীতি-কৌশলে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, যেহেতু রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে (এসওই) প্রচুর পরিমাণে সম্পদের জোগান রয়েছে, একটি বিচক্ষণ সম্পদ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এ সকল প্রতিষ্ঠানকে আরও উৎপাদনক্ষম করা; এসওই-গুলোর ব্যবস্থাপনা আরও দক্ষ করে তুলতে ও তাদের মূলধনের পরিমাণ বাড়াতে সক্ষম প্রতিষ্ঠানগুলিকে পুঁজি বাজার থেকে অর্থয়ানের জন্য সরকারের উৎসাহ অব্যাহত রাখা; আন্তর্জাতিক পণ্যের মূল্যের অস্থিরতাজনিত ঝুঁকি থেকৈ এসওইকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য কিছু পণ্যের মূল্য সরাসরি ভোক্তা পর্যায়ে স্থানান্তর করা যেতে পারে। ইতোমধ্যে কতিপয় জ্বালানি পণ্যের ক্ষেত্রে এ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

এছাড়া, জলবায়ু ও দুর্যোগের কারণে সৃষ্ট অভিঘাতের ঝুঁকি প্রশমনে সরকার ‘ফিস্কাল বাফার’ রাখার কৌশল গ্রহণ এবং কিছু দুর্যোগপ্রবণ খাতের জন্য সরকারের বিমা পলিসি নেওয়ার বিষয়টি বিবেচনাধীন, উল্লেখ করা হয়েছে ওই নীতি-কৌশলে।

জানতে চাইলে বৃহস্পতিবার (৬ জুন) রাতে সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘দেশের অর্থনীতি তো অলরেডি ভেঙে পড়েছে, ঝুঁকি নতুন করে তারা আর কী বলবে। ইটস আ ব্রোকেন ইকোনমি।  এখানে নতুন করে ঝুঁকির বিষয়টি নিয়ে আর বলার কিছু নাই। অর্থনীতি গর্তের মধ্যে পড়ে গেছে। ঝুঁকি তো হবে তখন, যখন সামনে হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু আমরা তো অলরেডি গর্তের মধ্যে।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু প্রশ্ন তোলেন, ‘এই আর্থিক বিবরণ কীসের কাজে আসবে। এগুলো নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নাই, এটা হবে সেটা হবে। এখানে তো কোনও সেক্টর বাকি রাখে নাই। ফরেন কারেন্সি থেকে শুরু করে ব্যাংকিং সেক্টর, স্টক মার্কেট থেকে শুরু করে রেভিনিউ কালেকশন, সব শেষ করেছে তারা।’

প্রসঙ্গত, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ পেয়েছে বাংলাদেশ। সংস্থাটি ২০২৬ সাল পর্যন্ত সাড়ে তিন বছরে মোট সাত কিস্তিতে এই ঋণ দেবে। গত বছরের ২ ফেব্রুয়ারি প্রথম কিস্তির অর্থ ৪৭ কোটি ৬৩ লাখ ডলার এবং ১৩ ডিসেম্বর ৬৮ কোটি ২০ লাখ ডলার ঋণ পেয়েছে বাংলাদেশ। আগামীতে তৃতীয় কিস্তি পাওয়ার কথা রয়েছে। 

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments