Sunday, September 22, 2024
Google search engine
Homeদেশকতটা প্রাণঘাতী, মাংকিপক্স ভাইরাস

কতটা প্রাণঘাতী, মাংকিপক্স ভাইরাস

বিশ্বজুড়ে জনস্বাস্থ্যে জরুরি অবস্থা জারি করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। কারণ এখনও পর্যন্ত প্রায় ১১৬টি দেশে মাংকি পক্সের (এম-পক্স) প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর ডিজিজ প্রিভেনশন অ্যান্ড কন্ট্রোল দুদিন আগে জানিয়েছে–২০২২ সালের শুরু থেকে গত জুলাই (২০২৪) মাসের শেষ পর্যন্ত সারা বিশ্বের ১১৬টি দেশে মাংকি পক্সের ৯৯ হাজার ১৭৬ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে এবং মারা গেছেন ২০৮ জন। অপরদিকে ২০২৪ সালে আফ্রিকান সিডিসি জানিয়েছে, ১৪ হাজার ৭১৯ জন সন্দেহভাজন এবং ২ হাজার ৮২২ জনের দেহে এমপক্স শনাক্ত হয়েছে, এদের মধ্যে ৫১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। মাংকি পক্স নিয়ে বিস্তারিত তথ্য এখনও জানেন না অনেকেই। তাই এই রোগ নিয়ে শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

মাংকি পক্স কী
মাংকি পক্স একটি ভাইরাসজনিত প্রাণিবাহিত (জুনোটিক) রোগ। ১৯৫৮ সালে ডেনমার্কের একটি ল্যাবে বানরের দেহে সর্বপ্রথম এ রোগ শনাক্ত হয়—যার কারণে এর নামকরণ করা হয় মাংকি পক্স। তবে এই রোগের জন্য একমাত্র বানর দায়ী নয় বলে মনে করেন গবেষকরা। তাদের মনে করেন, এই রোগটির প্রাদুর্ভাব ১৯৭০ সাল থেকে প্রধানত মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকার ১১টি দেশে দেখা যায়। ইতোপূর্বে ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, সিঙ্গাপুরসহ অন্যান্য দেশেও এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা গেছে। তবে সেসব ক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তিদের আফ্রিকার দেশগুলোতে ভ্রমণের ইতিহাস, অথবা ওইসব দেশ থেকে আমদানি করা প্রাণীর সংস্পর্শে আসার ইতিহাস ছিল।

এমপক্স কেন হয়?
স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার দেওয়া তথ্যমতে, এমপক্সে আক্রান্ত বানর থেকে ইঁদুর, কাঠবিড়ালি, খরগোশ বর্গের পোষা প্রাণীর মাধ্যমে এই রোগ ছড়াতে পারে। তবে সাধারণত গৃহপালিত প্রাণী (যেমন- গরু, ছাগল, ভেড়া, হাঁস, মুরগি, মহিষ) থেকে এ রোগ ছড়ায় না। তবে সম্প্রতি মানুষ থেকে মানুষের মধ্যে ছড়ানোর প্রবণতা দেখা গেছে।

বিজ্ঞানীদের মতে, এমপক্স ভাইরাস মানুষ থেকে মানুষে ছড়াচ্ছে শারীরিক সংস্পর্শের মাধ্যমে। এই পক্সে সংক্রমিত ব্যক্তিকে স্পর্শ করা, চুমু দেওয়া, যৌন সম্পর্ক থেকে এটি ছড়াতে পারে। সংক্রমিত ব্যক্তির শ্বাস-প্রশ্বাসের খুব কাছাকাছি থাকলেও সংক্রমণ ঝুঁকি বেড়ে যায়।

এছাড়া এমপক্স আক্রান্ত বন্যপ্রাণী শিকার করা, চামড়া তোলা, মাংস কাটা, এমনকি রান্নার সময়, কম তাপে রান্না করা খাবার খেলে, সেখান থেকে ভাইরাস ছড়াতে পারে। এমপক্স আক্রান্ত প্রাণীর কাছাকাছি গেলেও সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি আছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, এমপক্স সংক্রমিত রোগীর ব্যবহার করা পোশাক, তোয়ালে, বিছানার চাদর, যেকোনও ব্যবহার্য জিনিসপত্র থেকে ভাইরাস ছড়াতে পারে। সংক্রমিত রোগীর ব্যবহার করা ইনজেকশনের সুঁই অন্য কারও শরীরে প্রবেশ করালেও এমপক্স হতে পারে।

এছাড়া অন্তঃসত্ত্বা নারী এমপক্স আক্রান্ত হলে অনাগত সন্তানও এমপক্স ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে। এমপক্স শুকিয়ে যাওয়ার পর ফোসকার আবরণ যদি বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে, সেখান থেকেও ভাইরাস সংক্রমণ হতে পারে।

এমপক্সের লক্ষণ কী
চিকিৎসকদের মতে, মাংকিপক্স রোগের সাধারণ উপসর্গগুলো হচ্ছে—জ্বর (৩৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বা ১০০ ফারেনহাইটের বেশি তাপমাত্রা), প্রচণ্ড মাথাব্যথা, শরীরের বিভিন্ন জায়গায় লসিকা গ্রন্থি ফুলে যাওয়া ও ব্যথা (লিম্ফ্যাডিনোপ্যাথি), মাংসপেশিতে ব্যথা, অবসাদগ্রস্ততা, সাধারণত জ্বরের ৩ দিনের মধ্যে ফুসকুড়ি হওয়া—যা মুখ থেকে শুরু হয়ে পর্যায়ক্রমে হাতের তালু, পায়ের তালুসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। উপসর্গগুলো সাধারণত ২ থেকে ৪ সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হয়।

মাংকিপক্স রোগীর দেহে লক্ষণ দেখা না দিলে রোগী থেকে অন্য কারও মধ্যে ভাইরাসটি ছড়ায় না। শরীরে ফুসকুড়ি (ভেসিকল, পাস্তিউল) দেখা দেওয়া থেকে শুরু করে ফুসকুড়ির খোসা (ক্রাস্ট) পড়ে যাওয়া পর্যন্ত আক্রান্ত ব্যক্তির কাছ থেকে রোগ ছড়াতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উপসর্গগুলো আপনা-আপনি সেরে যায়।

এম পক্সের ঝুঁকিতে কারা
স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, নবজাতক শিশু, অন্তঃসত্ত্বা নারী, দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তি (যেমন- অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, কিডনি রোগী, ক্যানসারের রোগী, এইডসের রোগী) এই রোগের ঝুঁকিতে সবচেয়ে বেশি থাকেন।

লক্ষণ দেখা দিলে যা করতে হবে
আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে অথবা আক্রান্ত দেশ থেকে ফিরে আসার ২১ দিনের মধ্যে জ্বর এলে এবং ফুসকুড়ি দেখা দিলে—এমপক্স ভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কা থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে অতিদ্রুত স্বাস্থ্য অধিদফতরের হটলাইন ১০৬৫৫ নম্বরে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে।

এমপক্সের চিকিৎসা কী?
চিকিৎসকরা বলছেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উপসর্গগুলো আপনা-আপনি উপশম হয়ে যায় বলে নির্দিষ্ট চিকিৎসা প্রয়োজন হয় না। তবে উপসর্গ নিরাময়ে চিকিৎসা গ্রহণ করতে হয়। যেমন- জ্বর হলে প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ, ফুসকুড়ি শুকনো রাখা, পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ, পরিমিত বিশ্রাম, পর্যাপ্ত পানি ও তরল জাতীয় খাবার গ্রহণ ইত্যাদি। এছাড়া শারীরিক জটিলতা দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মাংকি পক্সের লক্ষণ দেখা দেওয়ার পর আক্রান্ত ব্যক্তির সরাসরি সংস্পর্শে আসা থেকে বিরত থাকতে হবে। আক্রান্ত ব্যক্তি এবং সেবা প্রদানকারী উভয়কেই মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। নিয়মিত সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে এবং আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত দ্রব্যাদি সাবান/ জীবাণুনাশক/ ডিটারজেন্ট দিয়ে জীবাণুমুক্ত করতে হবে। আক্রান্ত জীবিত কিংবা মৃত বন্যপ্রাণী থেকে দূরে থাকতে হবে।’

এ রোগে কী কী জটিলতা হতে পারে?
স্বাস্থ্য অধিদফতরের দেওয়া তথ্যমতে, প্রায় সব ক্ষেত্রেই কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আক্রান্ত ব্যক্তি সুস্থ হয়ে যায়। তবে দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের (যেমন- অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, কিডনি রোগী, ক্যানসারের রোগী, এইডসের রোগী, নবজাতক শিশু, অন্তঃসত্ত্বা নারী) ক্ষেত্রে এটি শারীরিক জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। শারীরিক জটিলতাগুলোর মধ্যে রয়েছে—ত্বকে সংক্রমণ, নিউমোনিয়া, মানসিক বিভ্রান্তি, চোখে প্রদাহ এবং দৃষ্টিশক্তি লোপ পেতে পারে।

ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘এই রোগের সুনির্দিষ্ট কোনও চিকিৎসা নেই, সরাসরি ওষুধ নেই। রোগীকে আইসোলেশনে রেখে চিকিৎসা দিতে হবে। এমপক্স নিয়ে আমাদের উদ্বেগের কারণ নির্ভর করবে—আমাদের আশপাশের দেশগুলোতে সংক্রমণ কেমন তার ওপর। এজন্য আমাদের এখন থেকেই দেশের প্রবেশপথগুলোতে স্ক্রিনিং জোরদার করতে হবে। লক্ষণ দেখা দেওয়া ব্যক্তিদের পরীক্ষা করাতে হবে। এমপক্স আক্রান্ত দেশ থেকে আসা যাত্রীদের বিশেষ নজর দিতে হবে।’

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments