
বাংলার প্রতিচ্ছবি : আয়নাঘরের ভয়াবহ ও লোমহর্ষক বর্ণনা দেন সাবেক রাষ্ট্রদূত এম মারুফ জামান। হাসিনা সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই) পরিচালিত বহুল আলোচিত আয়নাঘরে তাকে দীর্ঘদিন বন্দি রাখা হয়।
বুধবার রাজধানীর গুলশানের বাসভবনে তিনি যুগান্তরকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অপহরণের প্রেক্ষাপট, বন্দিজীবন এবং গুমের সঙ্গে জড়িতদের সম্পর্কে নানা তথ্য তুলে ধরেন।
মারুফ জামান বলেন, সবাই যেটাকে আয়নাঘর বলছে, সেটি আসলে ডিজিএফআই পরিচালিত যৌথ জিজ্ঞাসাবাদ সেল বা জেআইসি। সাধারণত বড় মাপের জঙ্গি, সন্ত্রাসী বা চিহ্নিত অপরাধীদের জেআইসিতে নিয়ে বিশেষ কৌশলে জিজ্ঞাসাবাদের রেওয়াজ ছিল। কিন্তু শেখ হাসিনার আমলে এটি ভিন্নমত দমনে নিকৃষ্টতম টর্চার সেলে পরিণত হয়। এমনকি সেখানে দীর্ঘদিন বন্দি রাখার পর অনেককে নিষ্ঠুর কায়দায় হত্যা করা হয়। তাদের লাশ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। ২০১৭ সালের ৪ ডিসেম্বর তাকে বিমানবন্দর এলাকা থেকে অপহরণ করা হয়। পরে কোনো বিচার প্রক্রিয়া ছাড়াই ১৬ মাস তাকে সেই আয়নাঘরে বন্দি করে রাখা হয়।
কারণ জানতে চাইলে মারুফ জামান বলেন, এর কারণ একটাই-ভারতীয় আগ্রাসন এবং হাসিনা সরকারের সমালোচনা। সাবেক কূটনীতিক হিসাবে তিনি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন জার্নালে লেখালেখি করতেন। বিশেষ করে তার বেশকিছু লেখা সরাসরি ভারতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে চলে যায়। এ কারণে শেখ হাসিনার পাশাপাশি ভারতীয় স্বার্থান্ধ গোষ্ঠী তার ওপর নাখোশ হয়ে ওঠে।
মারুফ জামান বলেন, আপনাদের অজানা নয় যে হাসিনা সরকারের ৯৬ থেকে ২০০১ মেয়াদে ভারত ব্যাপকভাবে উজানে পানি নিয়ন্ত্রণ করে। এতে বাংলাদেশের কয়েকটি অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যায়। দেখা দেয় ভয়াবহ আর্সেনিক দূষণ। এ সময় সুন্দরবন এলাকায়ও লবণাক্ততা বাড়ে। এতে ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নালে এসব তুলে ধরার ফলে বাংলাদেশের ভারতীয় দূতাবাস ক্ষুব্ধ হয়। এসব থেকে তাকে নিবৃত্ত রাখার চেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু এতে তারা সফল হয়নি।
এছাড়া প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের প্রতি তার বিশেষ আকর্ষণ ছিল। সামরিক বাহিনীতে চাকরিকালীন একজন জুনিয়র অফিসার হিসাবে তিনি জিয়ার সংস্পর্শে এসেছিলেন। জিয়ার আদর্শ তাকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করেছিল। এসব কারণে শেখ হাসিনা তাকে বিএনপি ঘনিষ্ঠ হিসাবে চিহ্নিত করে।
মারুফ জামান জানান, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে তাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়। এরপরও তিনি হাসিনা সরকারের সমালোচনা অব্যাহত রাখেন। এ সময় তাকে ডিজিএফআই থেকে নানা ধরনের হুমকি দেওয়া হয়। কিন্তু এতেও তিনি পিছপা হননি। একপর্যায়ে তাকে অপহরণ করা হয়।
তিনি জানান, অপহরণের অনেক আগে থেকেই ডিজিএফআই-এর লোকজন তার গতিবিধির ওপর নজর রাখত। তার ধানমন্ডির বাসার আশপাশে সার্বক্ষণিক গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা অবস্থান করতেন। ঘটনার দিন (৪ ডিসেম্বর) তার দুই মেয়ে বিদেশ থেকে দেশে ফেরে। তিনি সন্তানদের আনতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু বিমানবন্দরে ঢোকার আগ মুহূর্তে তার গাড়ি আটকানো হয়। অস্ত্রের মুখে ৮/১০ জন লোক চোখ বেঁধে তাকে গাড়িতে তুলে নেয়। একপর্যায়ে তাকে ডিজিএফআই-এর এক অন্ধকার টর্চার সেলে বন্দি রাখা হয়।
মারুফ জামান জানান, ১৬ মাস তার প্রতিটি মুহূর্ত কাটে মৃত্যু আতঙ্কের মধ্য দিয়ে। একজন অফিসার ৩-৪ দিন পরপর এসে জিজ্ঞাসাবাদ করতেন। চলত বেধড়ক পিটুনি। এক ঘুসিতে তার মুখের একদিকের প্রায় সব দাঁত পড়ে যায়। ছিঁড়ে যায় পায়ের লিগামেন্ট। অফিসার চলে গেলে আহত অবস্থায় তিনি মেঝেতেই পড়ে থাকেন। ন্যূনতম চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। ক্ষতস্থানে ঘা হয়ে যায়। দাঁত ভাঙা মাড়িতে পচন ধরে। খাবার চিবিয়ে খাওয়ার মতো শক্তিও ছিল না। তিনি জানান, যেখানে তাকে বন্দি রাখা হয়, সেই জায়গাটা ছিল খুবই ছোট। বাইরের আলো সেখানে পৌঁছায় না। ঘড়ঘড় করে সারাক্ষণ তীব্র শব্দ করা হয়। স্যাঁতসেঁতে মেঝেতে তেলাপোকা, আরশোলার ছড়াছড়ি। প্রচণ্ড মশার উৎপাত। ফলে একমুহূর্ত ঘুমের সুযোগ ছিল না। কিন্তু মৃত্যু আতঙ্কের মধ্যে এমন কষ্টগুলো ছিল অনেকটাই গৌণ।
মারুফ জামান জানান, সব থেকে নিকৃষ্ট গ্রেড-২ টর্চার সেলে তাকে বন্দি রাখা হয়। সারাক্ষণ মানুষের কান্না আর গোঙানির শব্দ আসত। নানা কায়দার নির্যাতন হতো। এর অন্যতম ছিল ওয়াটার বেডিং থেরাপি। এতে মুখের ওপর ভেজা কাপড় রেখে পানি ঢালা হয়। এতে দম বন্ধ হয়ে আসত। এতে বন্দিরা ছটফট করে। সারাক্ষণই চলত এসব। দু-একজনকে মাঝেমধ্যে পেছনে দুই হাত বেঁধে বাইরে কোথাও নিয়ে যাওয়া হতো। কিন্তু তাদের কেউ কেউ আর কখনোই ফিরে আসত না। প্রহরীদের কেউ কেউ চুপিসারে তাদের মেরে ফেলার কথা জানাতেন। মারুফ জামান জানান, দীর্ঘদিন বন্দি থাকায় তিনি জায়গাটি চেনার চেষ্টা করেন। আশপাশের শব্দ, মসজিদের আজান এবং খাবার পরিবেশনের ধরন দেখেও তিনি সেটিকে সামরিক স্থাপনা হিসাবে শনাক্ত করেন। একপর্যায়ে নিশ্চিত হন তাকে ঢাকা সেনানিবাসের পাশে কচুক্ষেতে অবস্থিত ডিজিএফআই কার্যালয়ে বন্দি রাখা হয়েছে।
তিনি জানান, প্রতি শুক্রবার তাকে খিচুড়ি দেওয়া হতো। এর সূত্র ধরে তিনি দিন-তারিখের হিসাব রাখতেন। তবে আয়নাঘরে কোনো বন্দিকে চা দেওয়া হলে প্রহরীরা সতর্ক হয়ে যেতেন।
মারুফ জামান জানান, এক প্রহরী একদিন তার কাছেও চা নিয়ে আসেন। এতে তিনি বিস্মিত হন। তখন ওই প্রহরী তাকে বলেন, ‘স্যার আপনাকে হয়তো মেরে ফেলবে না। ডিসেম্বরে নির্বাচনের পরই ছাড়া পেতে পারেন।’ একপর্যায়ে ভিন্ন একটি কক্ষে তার ডাক পড়ে। সেখানে একজন অফিসার তাকে বলেন, তোমাকে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আগামী এক বছর বাইরের কারও সঙ্গে কথা বলা যাবে না। কোথাও কোনো সাক্ষাৎকার দেবে না। শর্ত ভঙ্গ করলে তোমার দুই মেয়েকে শেষ করে দেওয়া হবে। ফলে সন্তানদের জীবনের নিরাপত্তার কথা ভেবে মুক্তির পর তিনি নীরব হয়ে যান। হাসিনার পতনের আগ পর্যন্ত তিনি কোথাও কোনো কথা বলতে পারেননি। মারুফ জামান জানান, সাবেক সেনাপ্রধান আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হক তার কোর্সমেট ছিলেন। নিখোঁজ বাবার সন্ধান পেতে তার দুই মেয়ে বেলালের সঙ্গে যোগাযোগ করে। কিন্তু সাহায্য দূরের কথা, তিনি ন্যূনতম সাড়া দেননি। ১৬ মাস পর ২০১৯ সালের ১৪ এপ্রিল রাতে তিনি বাসায় ফেরেন। সেদিন ধানমন্ডিতে তার বাসার সামনে তাকে ফেলে দিয়ে যায়।
তিনি জানান, ফিরে আসার পর অজ্ঞাত ভয়ে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের অনেকে দূরে সরে যান। ফোনে কল করলেও অনেকে কল রিসিভ করেননি। ফ্যাসিবাদের পতনের পর এ ধরনের পরিস্থিতি বদল হলেও বিচার সেভাবে গতি পায়নি। সরকারের ভেতর থেকেই হয়তো কেউ আয়নাঘরের ঘটনা ধামাচাপা দিতে চায়। কারণ, ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের অনেকেই এখনো স্বপদে বহাল।