বাংলার প্রতিচ্ছবি । ২০ নভেম্বর ২০২৪ !! ১১:৩৩
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের জন্মদিন আজ। ১৯৬৭ সালের এই দিনে (২০ নভেম্বর) তার জন্ম। ১৯৭১ সালে কনিষ্ঠ কারাবন্দিদের একজন। ২০০৮ সাল থেকে তিনি লন্ডনে নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন। বিগত বছরগুলোয় তার দেশে ফেরার কোনও আলাপ ওঠেনি। তবে এ বছর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তারেক রহমানের দেশে ফেরার বিষয়টি দলের উচ্চপর্যায়ে আলোচনা হয়। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক হিসাবনিকাশ ও সরকারের অবস্থানও ভূমিকা রাখছে।
নিজের জন্মদিন নিয়ে বিএনপির শীর্ষনেতা তারেক রহমান নিজের পক্ষ থেকেই কোনও ধরনের আয়োজন করার নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন। দল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে দুবার প্রেস বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দলের শীর্ষনেতার জন্মদিন পালনে আনুষ্ঠানিকভাবে কেন কঠোর হতে হলো বিএনপিকে? বিষয়টি নিয়ে একাধিক নেতা মনে করেন, শীর্ষনেতার জন্মদিনকে কেন্দ্র করে একটি স্বার্থান্বেষী মহল ‘অর্থ-সংশ্লিষ্ট’ কার্যক্রম চালায়। নেতাকর্মীদের থেকে অর্থ উত্তোলন করা হয়। বিগত সময়ে এ ধরনের অভিযোগ দলের উচ্চ পর্যায়ে উঠেছে।
মঙ্গলবার রাতে একটি সূত্র উল্লেখ করে, ‘এই ধরনের অনুষ্ঠানের নামে বাংলাদেশে এক ধরনের রাজনৈতিক কর্মী দলীয় ও তার সমর্থকদের কাছে অর্থ সংগ্রহ করে। এটা এই যদি হয় তাহলে নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করবে। সেজন্য তিনি (তারেক রহমান) কঠোর হয়েছেন, বিশেষ করে নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করতে পারে এরকম কাজে।’
মঙ্গলবার বিএনপির ৩১ দফা নিয়ে অনুষ্ঠিত একটি কর্মশালায় তারেক রহমান নিজের নামের আগে ‘দেশনায়ক’, ‘রাষ্ট্রনায়ক’ শব্দ ব্যবহার করতেও মানা করেছেন। দলের নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন, তারা যেন নামের আগে এই দুটি বিশেষণ ব্যবহার না করেন।
দলের কেউ কেউ মনে করেন, এর পেছনে রাজনৈতিক বার্তা আছে। বিশেষ করে বেগম খালেদা জিয়া এবং তার বিদেশযাত্রার বিলম্ব বা অনিশ্চয়তা; এবং সর্বশেষ মঙ্গলবার রাতে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপির চেয়ারপারসনের কাছে আমন্ত্রণপত্র গেছে।
রাজনৈতিক কর্মী ও পর্যবেক্ষকদের কেউ-কেউ এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে তারেক রহমানের রাজনৈতিক ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠার একটি চেষ্টা বিএনপির মধ্যে রয়েছে। এক্ষেত্রে নাগরিক সমাজেও ইতিবাচক প্রভাব আসতে পারে বলে মনে করেন কেউ-কেউ।
এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করলে বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান বলেন, ‘ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সার্বিক বিবেচনায় ইতিবাচক অবস্থানে রয়েছেন এবং ভূমিকা রাখছেন। তিনি বিশ্বাস করেন দেশের কল্যাণে গুণগত পরিবর্তন আনতেই হবে ইতিবাচক অবস্থানের কোনও বিকল্প নেই’।
২০১৮ সালে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হওয়ার পরেই স্থায়ী কমিটির বৈঠককে সুনির্দিষ্ট এজেন্ডাভিত্তিক করেছিলেন তারেক রহমান। বিভিন্ন সিদ্ধান্ত এককভাবে নিলেও আগে সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে আলোচনার করার বিষয়টি সমানভাবে পালন করতেন তিনি।
দলের স্থায়ী কমিটির প্রবীণ সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকারের ভাষ্য, ‘তারেক রহমান দলের নেতৃত্বে অসাধারণ ভূমিকা রাখছেন। আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। আমার মতো একজন বয়সী লোকও কমিটিতে আছি, কথা বলছি, মতামত দিচ্ছি।’
২০০১ সালে ক্ষমতায় আসার পর বিএনপি জামায়াতকে নিয়ে মন্ত্রিসভা করার পর নতুন বিতর্ক উঠে। এই জোট সরকারের সময় দশ ট্রাক অস্ত্র মামলা, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলাসহ নানা মামলায় তারেক রহমানকে যুক্ত করে মামলা করে তৎকালীন মঈন-ফখরুদ্দিন সরকার। এমনকি ওই সময় ‘হাওয়া ভবন’ বিতর্ক শুরু হয়।
বিএনপির ভাষ্য, ‘২০০৭ সালে আওয়ামী লীগ সমর্থিত সামরিক শাসকদের বেআইনি ক্ষমতা দখলের পর তারেক রহমানের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’
২০০৮ সালের নভেম্বরে লন্ডন গিয়ে চিকিৎসা গ্রহণের পর তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ২০১৮ সাল থেকে মূলত দলের মূল সাংগঠনিক নেতৃত্ব একাই সামলে নেন। এবার সরকার পতনের পর বিএনপির নেতাকর্মীদের চাঁদাবাজি, হয়রানি, দখলসহ নানা অভিযোগে নেতাকর্মীদের দল থেকে বহিষ্কার করেন। কোথাও কোথাও ক্ষতিগ্রস্তকে আর্থিকভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে বিএনপি।
ইতোমধ্যে আমরা বিএনপি পরিবারের ব্যানারে তারেক রহমানের আর্থিক সহযোগিতা পাচ্ছে অভ্যুত্থানে নিহত ও আহত, চিকিৎসাধীন, ক্ষতিগ্রস্তরা। নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে অনুষ্ঠেয় ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করেছেন তারেক রহমান। ইতোমধ্যে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বক্তব্যে তিনি ভোটের ওপর জোর দিচ্ছেন।
মঙ্গলবার এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘জনগণের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তি যদি না হয়, তাহলে যে সংস্কারই করি, কোনোটিই কাজে লাগবে না। রাজনৈতিক মুক্তি হচ্ছে জনগণের কাছে জবাবদিহি। যার যা ইচ্ছা করে যাবে, সেটা হবে না। সেটা সরকারি দল হোক, বিরোধী দল, এমপি হোক, মন্ত্রী হোক, জনগণের কাছে এর জবাব দিতে হবে। এটি নিশ্চিত করতে হলে ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।’ ভোটের মাধ্যমেই জবাবদিহি তৈরি হয়, বলে উল্লেখ করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।
বাস্তবভিত্তিক ও ভোটে মানুষকে আগ্রহ সৃষ্টি করে এমন বিষয়গুলোর ওপর জোর দিয়েছেন তারেক রহমান। নেতাকর্মীদের বলেছেন, উঠান বৈঠকে যোগ দিতে। একইসঙ্গে দলের তিন মাসব্যাপী কর্মসূচিতে সারা দেশের ইউনিয়নগুলোতে কৃষক সমাবেশ ডেকেছেন।
দলের বিষয়ের সঙ্গে নিজের জন্মদিন ও নিজের নামের আগে বিশেষণ ব্যবহার নিয়ে প্রকাশ্যে বক্তব্য দিয়েছেন তারেক রহমান। ২০ নভেম্বর জন্মদিন হলেও তা পালনে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে দলীভাবে। পাশাপাশি ঢাকা বিভাগীয় একটি প্রশিক্ষণ কর্মশালায় তিনি বলেন, ‘একজন সহকর্মী হিসেবে আমার অনুরোধ রইলো, আপনাদের নেতা হিসেবে দয়া করে আমার নামের সঙ্গে আজকের পর থেকে দেশনায়ক, রাষ্ট্রনায়ক ব্যবহার করবেন না।’
ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের আগে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান ও সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তারেক রহমান।
স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় থেকেই রাজনৈতিক ও সামরিক পরিবেশে প্রসারিত হয়েছে তারেক রহমানের শৈশব। পারিবারিকভাবে ‘পিনো’ নামটিতে পরিচিত তিনি। একাত্তরের ১৬ মে চট্টগ্রাম থেকে পালিয়ে যখন মা খালেদা জিয়া, ভাই আরাফাত রহমান কোকোর সঙ্গে আরেকজন সহযোগী সহযোগিতায় নারায়ণগঞ্জের তিনি রওয়ানা হন লঞ্চে।
সিনিয়র সাংবাদিক সৈয়দ আবদাল আহমেদ রচিত ‘নন্দিত নেত্রী খালেদা জিয়া’ শীর্ষক গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ১৬ মে, ১৯৭১ সালের কথা স্মরণ করে তারেক রহমান পিনো বলেন, ‘.. সকালে রওয়ানা দিয়ে লঞ্চটি এসে সন্ধ্যায় নারায়ণগঞ্জ ঘাটে ভিড়ে। পথে আমরা কান্নাকাটি করিনি। নদীর পনির কলকল শব্দ, লঞ্চের ভেপু, ও মাঝে মাঝে লঞ্চ দোল খাওয়ার ঘটনা আমি উপভোগ করছিলাম।’
রাজনৈতিক উত্থান-পতনের একজন সাক্ষী এবং অংশগ্রহণকারী তারেক। স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার সাবেক প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বীর উত্তম সশস্ত্র সংগ্রামে তখন তাকে, তার মা এবং ভাইকে, অন্যান্য আরও অনেক মুক্তিযোদ্ধা সামরিক কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে গ্রেফতার করা হয়। তিনি ছিলেন কারাবন্দি হওয়া কনিষ্ঠ কারাবন্দিদের একজন।
বিএনপির দলীয়সূত্রের তথ্য, ঢাকার বিএএফ শাহীন কলেজে প্রাথমিক পড়াশোনা শেষ করে ১৯৮০-এর দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে ভর্তি হন তারেক রহমান।
এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় তিনি তার মায়ের সঙ্গে রাজপথে আন্দোলনে যোগ দেন এবং ১৯৮৮ সালে দলের গাবতলী উপজেলা ইউনিটে সাধারণ সদস্য হিসেবে বিএনপিতে যোগদান করেন। তিনি তৃণমূল থেকে জনগণকে সংগঠিত করেছিলেন এবং এইচ এম এরশাদের সরকারের পতনে অবদান রেখেছিলেন।
১৯৯১ সালের নির্বাচনের আগে তিনি তার মা বেগম খালেদা জিয়ার সাথে দেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় প্রচারণা চালিয়ে নির্বাচনে বিজয় অর্জন করেন। তার মা বেগম জিয়া বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন।
তিনি বগুড়ায় তৃণমূল থেকে নেতা নির্বাচনের প্রক্রিয়ার সূচনা করেছিলেন, যেখানে বিএনপি শাখার একজন নির্বাহী সদস্য ছিলেন। ১৯৯৩ সালে বগুড়া জেলা ইউনিটে তিনি একটি সম্মেলনের আয়োজন করেন যেখানে গোপন ব্যালটের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচন করা হয়। বগুড়ায় সফল সম্মেলনের পর তিনি অন্যান্য জেলা ইউনিটকে গণতান্ত্রিকভাবে নেতা নির্বাচন করতে উৎসাহিত করেন।
২০০৭ সালে মঈন-ফখরুদ্দিনের সময় তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
দলের ওয়েবসাইটে জানানো করা হয়েছে, ‘তখনকার সরকারি দফতরের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা জানান যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান ব্যক্তিরা দুর্নীতি দমন কমিশনসহ বিভিন্ন দফতরের কর্মকর্তাদের রহমানের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করতে বাধ্য করেছিল।’
‘এসময় তার মা বেগম জিয়াকে দেশত্যাগে বাধ্য করতে তাকে গ্রেফতার করে নির্যাতন করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে যেতে হয়েছিল।’
তারেক রহমান ২০০৯ সালে বিএনপির সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালে, বেগম খালেদা জিয়া কারাবন্দি হন, তখন তাকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন মনোনীত করা হয়।
১৯৯৪ সালে, তারেক রহমান বাংলাদেশের প্রাক্তন নৌবাহিনী প্রধান এবং পরবর্তী সরকারের দুই বারের মন্ত্রী প্রয়াত রিয়ার অ্যাডমিরাল মাহবুব আলী খানের কন্যা ডা. জোবায়দা রহমানকে বিয়ে করেন। জোবায়দা রহমান একজন কার্ডিওলজিস্ট এবং ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে পড়াশোনা করেছেন। এই দম্পতির একমাত্র সন্তান ব্যারিস্টার জাইমা জারনাজ রহমান। তিনি এখন পড়াশোনা করছেন লন্ডনে।
প্রসঙ্গত, গত আগস্টে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, ‘তারেক রহমান দেশে ফিরবেন শিগগিরই।’