বাংলার প্রতিচ্ছবি । ১৬ জুলাই ২০২৪ !! ১৫:১৩
দেশের স্বাধীনতা অর্জনে মুক্তিযোদ্ধাদের মহান আত্মত্যাগের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তাদের সবসময় সবার কাছ থেকে সর্বোচ্চ সম্মান পাওয়া উচিত, যাতে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তারা গর্ববোধ করতে পারেন।
তিনি বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের সবসময় সর্বোচ্চ সম্মান দিতে হবে। তাদের সম্মানটা সর্বোচ্চ থাকবে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মঙ্গলবার (১৬ জুলাই) সকালে তার কার্যালয়ের (পিএমও) হলে ‘প্রধানমন্ত্রী ফেলোশিপ ২০২৪’-এর নির্বাচিত ফেলোদের পদক প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে এ কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন করা জাতি, তাই বিশ্বদরবারে বিজয়ী জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করেই চলবো। সেভাবেই আমাদের গড়ে উঠতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘‘সব থেকে বড় কথা, যারা মুক্তিযোদ্ধা তাদের কথাটা মাথায় রাখতে হবে। জাতির পিতা যে আহ্বান করেছিলেন, ‘যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে’, সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে পরিবার-সংসার সব কিছু ছেড়ে দিয়ে তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে। তাদের সেই আত্মত্যাগের মধ্য দিয়েই আমাদের বিজয় অর্জিত হয়েছে।’’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধারা অনেকেই জীবন দিয়েছেন, পঙ্গুত্ববরণ করে শত্রুকে পরাজিত করে আমাদের বিজয় এনে দিয়েছেন। কাজেই তাদের সবসময় সর্বোচ্চ সম্মান দিতে হবে। তাদের সম্মানটা সর্বোচ্চ থাকবে।’
তিনি বলেন, একটা সময় এই মুক্তিযোদ্ধারা অবহেলিত ছিল এবং তিনি (শেখ হাসিনা) সরকারে আসার পর থেকেই তাদের সবরকম সহযোগিতা করেছেন ও করে যাচ্ছেন।
দলমত নির্বিশেষে মুক্তিযোদ্ধারা যেন সম্মানিত হন সে কথা উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, ‘‘গর্ব করে যেন তারা বলতে পারেন, ‘আমি মুক্তিযোদ্ধা’। আমার মতামতের সঙ্গে নাও থাকতে পারে, আমার দলে নাও থাকতে পারে। কিন্তু তারপরেও সে মুক্তিযোদ্ধা। কাজেই আমার কাছে সবাই সম্মানিত। আর সেই সম্মানটা যুগ যুগ ধরে এ দেশের মানুষ তাদের দেবেন, সেটাই আমরা চাই। ‘
প্রধানমন্ত্রী ফেলোশিপ অর্জনকারীদের অভিনন্দন জানিয়ে ভবিষ্যতে এটি যেন কেউ বন্ধ করতে না পারে, সেজন্য ট্রাস্ট ফান্ড করে স্থায়ী বন্দোবস্ত করারও ঘোষণা দেন অনুষ্ঠানে। কেননা, ’৯৬ পরবর্তী তার সরকারের দেওয়া ফেলোশিপ পরবর্তী সময়ে বিএনপি-জামায়াত সরকার বন্ধ করে দিলে বিদেশে তাদের অনেক দুরবস্থায় পড়তে হয়েছিল।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গভর্ন্যান্স ইনোভেশন ইউনিট (জিআইইউ) এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মাস্টার্স ডিগ্রি পর্যায়ে ৩৯ জন ও পিএইচডি পর্যায়ে ১১ জনকে ‘প্রধানমন্ত্রীর ফেলোশিপ’-এর জন্য নির্বাচিত করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩৭ জন মাস্টার্স ডিগ্রি ও ১১ জন পিএইডি ফেলোকে অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী পদক হস্তান্তর করেন।
এ পর্যন্ত বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য প্রায় ৩৩৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩০৮ জন মাস্টার্স ফেলো এবং ১১৬ জন পিএইচডি ফেলোকে বৃত্তি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ২১৫ জন মাস্টার্স ফেলো এবং ২৬ জন পিএইচডি ফেলো তাদের ডিগ্রি সম্পন্ন করেছেন।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ফেলোশিপ ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গভর্ন্যান্স ইনোভেশন ইউনিটের কার্যক্রমের ওপর একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শিত হয়।
প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী ও প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গভর্ন্যান্স ইনোভেশন ইউনিটের মহাপরিচালক ড. মোহাম্মদ আবদুল লতিফ স্বাগত বক্তৃতা করেন। ফেলোশিপ লাভকারী কয়েকজন শিক্ষার্থীও অনুষ্ঠানে নিজস্ব অনুভূতি ব্যক্ত করে বক্তৃতা করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনি ইশতেহারে থাকা ‘দিন বদলের সনদ’ বাস্তবায়ন করে তার সরকার দেশকে জাতির পিতার রেখে যাওয়া স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা এনে দিয়েছে, যা ২০২৬ সাল থেকে কার্যকর হবে। সে সময় দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার এবং আসন্ন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এখন থেকেই আমাদের উপযুক্ত নাগরিক ও দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে হবে। সেজন্য আমরা প্রস্তুতি নিয়েছি এবং ২০৪১ সাল নাগাদ স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলবো। যেখানে জনশক্তি, গভর্নমেন্ট, ইকোনমি এবং সোসাইটিও স্মার্ট হবে এবং বিশ্বের যেকোনও দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারবে।
তিনি বলেন, ‘‘আমি একটা জিনিস দেখেছি, আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা সব থেকে মেধাবী। তাদের শুধু সুযোগটা করে দেওয়া, আর সেটাই আমাদের করতে হবে এবং সেটাই করে দিতে চাই। আর সেজন্যই এই ‘প্রধানমন্ত্রী ফেলোশিপটা’ আমরা প্রবর্তন করেছি।’’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি এই ফেলোশিপটাকেও একটা ট্রাস্ট ফান্ড করে, আইন করে দিয়ে যাবো, যেন ভবিষ্যতে আর কেউ এটা বন্ধ করতে না পারে। এটি মাঝ পথে বন্ধ হয়ে গেলে যে বিপদে পড়ে, সে বিপদটা আমি নিজে দেখেছি। অনেককে আমরা নিজেরা আমাদের প্রবাসী বাংলাদেশিদের অনুরোধ করে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়ে তারা যেন পড়াশোনা সম্পন্ন করে আসতে পারে, সে ব্যবস্থাও করেছি। কিন্তু এটা করতে গিয়ে যারা চাকরিজীবী ছিলেন, তাদের চাকরিও চলে যায়, বিএনপি তাদের চাকরি বাতিল করে দেয়।’
তিনি বলেন, ‘এবারে আমরা যে ফেলোশিপটা দিলাম, এটা চালু রাখতে গেলে ৫ হাজার কোটি টাকার একটা ফান্ড লাগে, আবার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় থেকেও আমরা স্কলারশিপ দিচ্ছি বা অন্যান্য ক্ষেত্রেও আছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা সেটা করতে পারবো, সে বিশ্বাস আমার আছে। এখানে টাকাটা বড় কথা নয়, বড় কথা আমার দেশের ছেলেমেয়েরা বিদেশে গিয়ে উচ্চ ডিগ্রি নেবে, তারা ফিরে আসবে এবং তাদের গবেষণা দেশের উন্নয়নের কাজে লাগবে, এটাই সব থেকে বড় কথা।’
তিনি বলেন, টাকার জোগাড় হয়েই যায়। কারণ ২০০৯ সালে তিনি যখন সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পান, তখনকার বাজেট ছিল মাত্র ৬৮ হাজার কোটি টাকার। সেখানে চলতি অর্থবছরে তার সরকার ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট দিতে সক্ষম হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এত বড় বাজেট যখন দিতে পেরেছি, তখন ওটাও আমি জোগাড় করে ফেলবো অসুবিধা নাই, একটু সময় লাগবে, কিন্তু করবো।’
তিনি বলেন, ‘একবার অভিজ্ঞতা হয়েছে—করার পরে থাকে না, নষ্ট করে দেয়। এটা যাতে আর নষ্ট করতে না পারে, সেজন্য ট্রাস্ট ফান্ড করে আমি এই ফেলোশিপ, স্কলারশিপসহ বৃত্তি যেগুলো দিচ্ছি, সেগুলোও যাতে থাকে, সেজন্য সব কিছুকেই ট্রাস্ট ফান্ডের আওতায় নিয়ে এসে, এটাকে একটা স্থায়ী ব্যবস্থা করে দেবো। যাতে করে উচ্চশিক্ষা নিতে গিয়ে বাবা-মা বা নিজের ওপর চাপ না পড়ে।’
জাতির পিতার কন্যা বলেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ে তোলার সময় যদি জাতির পিতা বিদেশে পাঠিয়ে পিএইচডি করিয়ে আনতে পারেন, তাহলে আমরা এখন পারবো না কেন? আসলে সেই চিন্তাটা থাকতে হবে।
তার সরকার ইতোমধ্যে ‘প্রধানমন্ত্রী ফেলোশিপ-২০২২ নীতিমালা’ প্রণয়ন করেছে উল্লেখ করে সরকার প্রধান বলেন, প্রতিবছর সরকারি কর্মকর্তা, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, বেসরকারি প্রার্থীদের মধ্যে এই প্রদেয় ফেলোশিপের সংখ্যা নির্দিষ্ট রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘এখানে হয়তো আরও অনেকেই যোগ্য আছেন, যাদের আমরা দিতে পারিনি। কিন্তু যখন আমরা একটা ভালো ফান্ড তৈরি করে ফেলতে পারবো, তখন আশা করি আরও ভালোভাবে দিতে পারবো। তবে অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমেও আমরা দিচ্ছি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা সবসময়ই চাই—এই ফেলোশিপটার মাধ্যমে আমাদের উপযুক্ত নাগরিক গড়ে উঠবেন এবং আপনারা যে জ্ঞান অর্জন করবেন, সেটা দেশের কাজে লাগাবেন। কারণ এই পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়েই আমাদের চলতে হবে। আমরা কারও থেকে পিছিয়ে নয়, বরং এগিয়েই থাকবো।’
সরকারপ্রধান নির্বাচিত ফেলোশিপ অর্জনকারীদের উদ্দেশে বলেন, ‘একটা কথা মনে রাখবেন, এই টাকাটা আমাদের জনগণের টাকা। তারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে এই টাকা উপার্জন করে আপনাদের উচ্চশিক্ষা দিচ্ছেন। কাজেই জনগণ যেন সেই সেবাটা পায়, সেদিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে হবে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘জাতির পিতা ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও শোষণমুক্ত সমাজ গড়তে চেয়েছিলেন। কাজেই সেকথা মাথা রেখেই আমাদের দেশের সর্বস্তরের মানুষ কেউ অবহেলিত থাকবে না। এখানে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী আছে ও প্রতিবন্ধীরা আছে, তাদের সবার প্রতিই আমরা যথেষ্ট সহানুভূতিশীল, তারা যেন সমাজের সব রকম সুযোগ সুবিধাটা পায়। শিক্ষাদীক্ষায় তারাও যেন পিছিয়ে না পড়ে, সেদিকে আমরা বিশেষ নজর দিচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘আমি সব থেকে আনন্দিত, আমাদের একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হার্ভার্ডে যাচ্ছেন, আমাদের পুলিশের একজন সাব-ইন্সপেক্টর শেফিল্ডে যাচ্ছেন, অক্সফোর্ডে কেউ যাচ্ছেন। এরকম বিশ্বের বহু স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে তারা লেখাপড়া ও গবেষণার সুযোগ পাচ্ছেন।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি আশা করি আপনাদের এই শিক্ষা আমাদের বাংলাদেশকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে সহযোগিতা করবে। কারণ, লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা, এটা কখনও ব্যর্থ হতে পারে না।’
তার একটানা সরকার পরিচালনার সুযোগ লাভে দেশের উন্নয়নের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘এই দেশকে যতটুকু এগোতে পেরেছি আজকে বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। কিন্তু আমি চাই আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম এবং প্রজন্মের পর প্রজন্ম যেন এই মর্যাদা নিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে, সেভাবেই গড়ে তুলতে চাই। এজন্য শিক্ষাদীক্ষা যা যা প্রয়োজন, আমি যতক্ষণ সরকারে আছি, সে ব্যবস্থা করে যাবো। ভবিষ্যতের জন্যও করে যাবো।’ খবর: বাসস